ঢুঁণড়ো মত্ - রজত চক্রবর্তী

'ভালো থাকা' টা সম্পূর্ণ একটি 'থট অব অ্যাবসার্ডিটি'। আমার মনে হয়। ভালো থাকার জন্য প্রাণান্তকর এই ছোটা; ছুটতে ছুটতে ছুটতে সেই শেষ বিন্দুতে এসে পৌঁছে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে ভেবে নেওয়া ভালো থাকাটা আর হলো না! ভালো থাকাটা...
কথা শেষ হবার আগেই কমলিকা আরো ঘন হয়ে উঠল। আমার সমস্ত দৃষ্টি জুড়ে ওর কপালের গোল টিপ। মেরুণ। বেশ বড়। দূরে নদীটির তীরে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। নাকে গোধূলি ঠিকরে গিয়ে লেপ্টে আছে গালে। গালের ঢালে চূড়ান্ত ডাক।কমলিকার গভীর চোখে ভালো থাকার পাঠশালার দোর হাট। হু হু হাওয়ার শব্দ। ভালো ভালো আরো ভালোর ভেতর ডুব দিই...ডুব দিই।
এই একটি বিষয় নিয়েই যুগমানবরা হত্যে দিয়ে গাদা গাদা পুঁথি-পত্তরের পর পত্তর লিখে লিখে অক্লান্ত। ভূর্জপত্র থেকে আজও ল্যাপটপ ল্যাপে এনে লিখেই চলেছে। ভালো থাকার নানান নিদান। মানুষ সাময়িক লাফাচ্ছে। এই তো ভালো আছি, আলোয় আলোয় পাতায় পাতায় । একটা সময় পর্যন্ত ভালো থাকার নিদানে তৃপ্ত মানুষ আবার পেছন ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে আরেক নিদানখোড়ের কাছে। নতুন মঠ, নতুন আখড়া, নতুন পথ, নতুন মত...আবার যাত্রা...
কমলিকা যখন উঠল তখন ওর কপালের টিপ নেই। গালের গোধূলি উধাও । দেখো, ভালো থাকতে চাওয়াটা খূব জরুরী, ভালো থাকাটা অর্জন করতে হয়...কমলিকা শাড়ি গোছায়।
সাধুর চোখ লাল। বডি সাদা। কৌপিন লাল। হরিদ্ধারে সেবার কুম্ভ। মন্দিরের উল্টো দিকে একটা তাঁবু। ছোট্ট। রাত দেড়টা দুটো। গঙ্গার ঝরঝর আওয়াজ রাতে বেশি মনে হয়। একটু বসেছি তাঁবুর বাইরে ধুনির পাশে, বাবা ভালো থাকতে চাইছি, খুশসে রহনা.. কলকে ফিরিয়ে দিলাম পাশে বসা এক খালি গায়ে উপসাধুকে।
বাবার স্পেশাল কলকের আগুন ঝলসে উঠল, নেহি মিলেগি। দম্।
তবে মানে তব ক্যয়সে...?
যো চিজ তুম ঢুণরহো বেটা, উহো চিজ নেহি দিখা রহি, নেহি দেখা যায় গা, ঢুঁণরো মত, উও আপনি আপ আ যায়গা....চল ওয়াক্ত হো গিয়া...চার বাজে যানা হ্যায়... নাহানে কে লিয়ে...। টালমাটাল আমাকে ফেল উঠে গেল। আমি তাকিয়ে দেখি কমলিকা চলে যাচ্ছে দূরে...
চলে এলাম। গঙ্গার ধার। মফস্বলের গঙ্গার ধারের এই জায়গাটা দুপুরে নির্জন থাকে। তখন যুবক-বেলা। অনেক স্বপ্ন। মানুষের জন্য আত্মনিবেদনের রগরগে স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে বালকবেলায় ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীনেরা। সদ্য সিগারেট ধরা বুক তখনও পরিস্কার, ঝকঝকে সাদা, ধান্দা ঢোকেনি।
শুধু খেতে-পরতে পাড়লেই ভালো থাকবে? মানুষ? সেটাই সেঁধিয়েছে মাথায়। সামনে ঢোলা পাজামা, হাড়গিলে চেহারায় জাপটে, একসময়ের সাদা থাকা, পাঞ্জাবী ।
চারমিনার সিগারেটে জম্পেশ টান দিয়ে বলল, শাসক মুক্ত সমাজ গড়তে হবে? নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য আমাদের লড়াই... পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়ার...
মাস্টারমশাই ছাড়া ক্লাস? মন্ত্রী ছাড়া দেশ! রাষ্ট্র!! তোলপাড় মাথায়!
আরেকটা চারমিনার ফস্, চারিদিকে কৃষক সমাজ লড়াই করছে, আমাদেরকে তৈরী থাকতে হবে...অর্থনৈতিক সাম্যের জন্য....
তাহলেই সবাই ভালো থাকবে? হাজার প্রশ্ন।
সেই স্বপ্ন টাই দেখতে হবে....
দেখতে দেখতে চলেছে নৌকা ঘাট থেকে ঘাটে ঘাটের পর ঘাট। সান বাঁধানো ঘাট। চকমেলানো ঘাট। কেয়ারি করা ঘাট। কাঁচা ঘাট। পাটা পাতা ঘাট। নারকোল গাছের গুঁড়ি ফেলা ঘাট। বাঁশ পেতে ঘাট। নাবাল মাটির ঘাট। ঝোপের ভেতর, ঘাট। ঘাটের পর ঘাট, মানুষের ভালো থাকার হাজার কসরৎ। ঘাটে বসে কমলিকা জলে সাদা পা বোলাচ্ছে। জল খিলখিল হেসে উঠছে ওর নিটোল পায়ের গোছে গোছে। আঙুলের খাঁজ দিয়ে গলে গলে নামছে আমোদে। হাঁটুর খয়েরি আভায় নীল পাড় শাড়ির। শাড়ি ভেজে না। এক সময় জলখেলা থেমে যায় । সব খেলার একটা উন্মাদনা শুরু থাকে আর উত্তেজক শেষ থাকে। মাঝের সময়টা শুধু পাটিগণিতের আঁক কষা।
বেনারসের ঘাটে গত পরশু থেকে দেখছি লোকটিকে। চটি পাশে খুলে। পাজামা পাঞ্জাবি। সাধারন। চাদরটা জড়িয়ে চুপটি বসে আছেন। নট নড়ন চড়ন। সকালেও দেখেছি। রাতেও দেখেছি। বসলাম পাশে। একটু আলাপ। তারপর দিন আরেকটু বেশি।
দেখুন, ভালো কেউ থাকতে পারে না আবার ভালো থাকাটা কেউ কারো নষ্ট করতে পারেনা।
মৃত্যু কোন কারন নয়?
যুগে যুগে মানুষ মৃতের উপর দিয়ে হেঁটে এসেছে। ভালো থাকাটা অর্জন করতে হয়। মৃত্যু সেখানে একটা ঘটনা মাত্র ।
মানে!
কেড়ে নেওয়া যায় না আবার কেউ কাউকে ভালোথাকা সাজিয়ে দিতে পারে না। ঐ দেখুন চান করে উঠে কি তৃপ্তিতে বাচ্চাকে মুছিয়ে দিচ্ছে মা। গরীব । ভীষন গরীব। পারবেন ওর ভালো থাকা নষ্ট করতে?
কেন পারব না? ওর ভেতরে লোভ ঢুকিয়ে মিছিলে নিয়ে গিয়ে হাবিজাবির রাগ ঢুকিয়ে ছেড়ে দেবো..
ঠিক। এই চলে এলেন। আসলে আমরা বাড়িতে, পাড়ায়, সমাজে, রাজ্যে, দেশে সবসময়েই জয় আর পরাজয়ের গল্পে মশগুল। আমরা জয়ী হতে চাই। মুহুর্ত এর জয়ী। জয়-পরাজয়ে রাজনীতি আছে। জমাট গল্প আছে। দোষারোপের র ফাইল আছে। চাপানউতোরের টক-ঝাল সিরিয়াল আছে। রগরগে চ্যাটচ্যাটে কী নেই কী নেই , শুণ্যস্থান ভরার অসম্ভব খেলা। খেলাটাই খেলি। খেলে যাই। ভালো থাকতে চাই কি!
আপনি?
জিজ্ঞেস করা হয় নি আর। ভালো থাকা না থাকার এই স্রোতে খড়কুটো ধরার চেষ্টায় চলেছি। চলেছি। এটাই তো ভালো থাকা। জ্বর-জ্বালা-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-হজমোলা-দাদ-হাজা- চুলকানি-সূর্যোদয়- সূর্যাস্ত- কোষ্ঠকাঠিন্য- অম্লদাহ সব সবকিছু জড়িয়ে এই যে চলেছি। দেখতে দেখতে, ধুঁকতে ধুঁকতে, শুঁকতে শুঁকতে চাখতে চাখতে কি ভালো এই চলা। ভালো থাকা না থাকার জীবন! আহা জীবন! জীবন-নদী! ভালো আছো হে! হে সফর! জীবনময় এই সফর-যাপন। প্রতি পদক্ষেপে রক্তবিন্দু ফুল, ফুল ফুটে থাকে পথে পথে। এই তো পরম!
কমলিকা হাতটা ধরে ফেলল ঠিক পা ফেলার আগে। হর-কি দুনের পথ। বড় বড় পাথর বিছানো পথ। সরু। পথের পাশে খাদ। খাদের ভেতর সবুজ অন্ধকার। পা ফেলতেই পাথর হড়কালো ! কমলিকা হাতটা ধরে ফেলল, খপ। সাদা। নরম। চাঁপা ফুল আঙুল । আমরা হাত ধরে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে থাকি। হাঁটতেই থাকি...

ভালো থাকতে চাই...
ঢুঁণড়ো মত্...আপসে আপ আয়গা... চলতে রহো বেটা...চলতে রহো...মিল জায়গা...
লাল বাবা গোমুখের পথে ভেষজ চা এগিয়ে দেয়...