ঠান্ডাটা জমিয়ে পড়েছে আজ। তার সাথে সারা দিন ধরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বিকেলে আকাশটা একটু পরিষ্কার হলেও পার্কটা আজ একদম খালি। ভেজা ঘাসে উড়ে বেড়াচ্ছে কতগুলো ফড়িং। অন্যদিন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোলাহলে ভরে ওঠে এক টুকরো সবুজ জমিটা। গেটের কাছে করুণ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ভোলা। একটা বেলুনও বিক্রি হল না আজ। সকালে তো বৃষ্টির জন্য বাড়ি থেকে বেরোতেই পারে নি। দুপুরের পর থেকে ঘুরছে। ভিজেও গেছে খানিকটা। কিন্তু লাভ কিছুই হল না। কিভাবে খালি হাতে বাড়ি ফিরবে! হতাশ হয়ে হাঁটতে শুরু করে। একবার বড় রাস্তার দিকে গিয়ে দেখা যাক। সিগনালের কাছে। যদি কিছু হয়।
গীতবিতান কমপ্লেক্সের চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল পার্থ। আজ রবিবার। সারাদিন বেশ আয়েস করেই কাটল। বৃষ্টির জন্য বাজারেও যেতে হয় নি। জমিয়ে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খাওয়া হল দুপুরে। টিভিতে একটা সিনেমা দেখল। শুধু তিথির জন্যেই খারাপ লাগছে। কোথাও ঘুরতে যাওয়া হল না। বৃষ্টিটা একটু কমে এলেও এত ঠান্ডা আর জোলো হাওয়া ...বাইরে যাবার মতো নয়। ওদের কমপ্লেক্সের সব বাচ্চাগুলোও আজ ঘরবন্দি। না হলে বিকেল হলেই ওরা ছুটতে থাকে সামনের পার্কে। প্রতিদিন মেলা বসে যায় যেন।তিথি ওকেও টেনে নিয়ে যায় মাঝে মাঝে। ভাগ্যিস এইটুকু খেলার সুযোগ আছে ওদের জন্যে। এই পার্কটা দেখেই ফ্ল্যাটটা পছন্দ করেছিল দীপিকা।
হঠাৎ ওর চোখ পড়ল বেলুনওয়ালাটার দিকে। আরে এটা তো সেই লোকটা। বেলুন দিয়েছিল তিথিকে। সেদিন পার্কে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পা একটু ছড়ে যায় তিথির। কিন্তু তার কান্না আর কিছুতেই থামতে চায় না। পার্থ চেষ্টা করেছিল বাড়ি নিয়ে যাবার। অথচ বন্ধুদের ছেড়ে সে বাড়িও ফিরবে না। কি করবে ওকে নিয়ে বুঝে উঠতে পারছিল না পার্থ। ঠিক তখনই এগিয়ে এসেছিল বেলুনওয়ালাটা। একটা বড় লাল রঙের বেলুন ওর হাতে দিতেই ভুলে গেছিল সব। আবার খেলতে শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছিল পার্থ। তিথির জন্যে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছিল সেদিন। পার্সটা পর্যন্ত পকেটে ঢোকানোর সুযোগ পায় নি। তাই লোকটাকে বলেছিল
-"এই সামনের ফ্ল্যাটেই আমরা থাকি । তুমি চলো তোমাকে টাকাটা দিয়ে দেব।"
-" না বাবু। থাক না। ওর মতো আমারও একটা মেয়ে আছে ঘরে। আমি বুঝি। ওর কান্না তো থামল।"
পার্থকে অবাক করে দিয়ে চলে গেছিল লোকটা। সত্যিই! এখনও এমন মানুষ আছে!
লোকটাকে ওপর থেকেই ডাকল ...
-" আরে ও বেলুনওয়ালা ...দাঁড়াও আসছি।"
টাকার ব্যাগটা নিয়ে তাড়াতাড়ি লিফ্টে করে নেমে আসে পার্থ।
-"আরে তুমি দেখছি ভিজে গেছো..."
-" আর কি করব বাবু! আমাদের তো বেরোতেই হবে। কি দেব বলুন?"
ওর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড খারাপ লাগে পার্থর। কী বা রোজগার এদের ! বেলুন বিক্রির টাকায় কি আর সংসার চলে! আবার একটা মেয়েও আছে বলেছিল! কী মনে করে সব কটা বেলুনের প্যাকেট কিনে নেয়। তিথি আজ সারাদিন গাল ফুলিয়ে বসে আছে। বাকি বাচ্চাগুলোরও এক অবস্থা। ওরা খুশি হবে দেখে। আর কদিন পর তো তিথির জন্মদিন। তখন তো অনেক বেলুন লাগবে। বেলুনের সাথে বাঁশি , মুখোশ , ছোট ছোট কয়েকটা খেলনা যা ছিল সব কিনে নিল পার্থ।
-"বল কত হয়েছে তোমার? "
এতটা আশা করে নি ভোলা। ভগবান কি এভাবেই শুনে নেয় মনের কথা? আনমনা হয়ে হিসেব করতে থাকে।
-"বাবু....আপনার হল গিয়ে
তিনশ কুড়ি টাকা।"
-" বেশ ...সব দিয়ে দাও।"
খানিকটা ইতস্তত করতে থাকে ভোলা।
-" একটা কথা বলব বাবু?"
-" হ্যাঁ বলো না!"
- এই একটা লাল বেলুন আর এই বাঁশিটা থাক।
-"কাউকে দেবে?"
-"আসলে...আজ আমার ঝুমুরের জন্মদিন। ওর জন্যে।
আজ আপনি না কিনলে কি নিয়ে যে বাড়ি ফিরতাম!!"
-" আমি না থাকলে অন্য কেউ কিনত। এ আর এমন কি! তা ওই বেলুন আর বাঁশির দামটাও আমি দিয়ে দিচ্ছি। তুমি তোমার মেয়েকে দিও।
-"না বাবু। ওটা আমাকেই দিতে দিন। বাবা হয়ে এটুকু তো আমি দিতেই পারি।আপনার মতো মন কজনের থাকে বলুন! আপনার জন্যেই আজ মেয়েটার মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারব।"
মিলিয়ে যাচ্ছে বেলুনওয়ালা। লাল বেলুনটা উড়ছে বাতাসে।সান্তাক্লজরা কি শুধু বড়দিনেই আসে! প্রতিটা হাসি ফোটানোর দিনই তো বড়দিন!!