নীলা - ইলোরা চট্টোপাধ্যায়

ছোট ভাইয়ের হাত ধরে অঝোরে কাঁদছে মনীষা। মায়ের ক্লান্ত মুখটা ঝুলে পড়েছে বুকের কাছে। বড়দা আর ভাইরা রাস্তায় ইতস্তত ভাবে ছড়িয়ে পড়া সংসারের জিনিস কুড়তে ব্যস্ত। চারিদিকে তীব্র শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ তীব্রতর হচ্ছে। রাজসভার ঘন্টা বাজছে অনর্গল। মণিমুক্ত সুসজ্জিত মহারাজ হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। সাদা চাদরে ঢাকা একটা মৃতদেহ। এক দমকা হাওয়ায় চাদরটা সরে যেতেই চন্দনের টিপ পরা বাবার মুখটা প্রকট হলো।
 ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে মনীষা। আজ নিয়ে তিনদিন এই স্বপ্ন। রাতে শুলেই ঘুরে ফিরে আসা কিছু আবছা মুখ, অশ্রাব্য ভাষা আর  রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া ব্যবহৃত জিনিস।

গত কিছুদিন হলো ওরা ভাড়া এসেছে কোন্নগরে এক নতুন পাড়ায়। ছোট একটা ঘর আর একটা ছোট অন্ধকার বারান্দা। বারান্দার গেট খুলে পুকুর পাড়ে যাওয়া যায় । ওই গেটটা খুললেই একফালি আলো আসে। বাকি সাতঘর ভাড়াটে। কলতলা, জল, বাথরুম বারোয়ারী, কেড়েকুড়ে নিয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা।

ছোটবেলা কিন্তু এমন ছিল না মনীষার। সে দিদি বড়দা  বড় হয়েছিল দ্বারভাঙ্গায়। দাদু ছিলেন দ্বারভাঙ্গা মহারাজের প্রধানমন্ত্রী। সেই সময় বড় ভালো কাটতো দিনগুলো। প্রধানমন্ত্রীর নাতনি হওয়ার সুবাদে আর্থিক স্বচ্ছলতা, আর প্রাচুর্যে বড় হওয়া।  কলকাতায় এলে দ্বার    ভাঙ্গা বিল্ডিং এ থাকা, তখনও ইউনিভার্সিটি নেয়নি বাড়িটা। অঢেলখাওয়া, ফিটন গাড়ি চেপে গঙ্গার হাওয়া খেতে যাওয়া, দামি পোশাক পরা, অতুল বৈভবে কেটে গেছিলো শৈশব।।

বাবা অবসর নেওয়ার পর দ্বারভাঙ্গা থেকে সপরিবারে উত্তরপাড়া চলে এল মনীষারা। পিসির বিয়ে হয়েছিল নামকরা বনেদি বাড়িতে আর পিসেমসাই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী।   পিসেমসাই ঠিক করে দিলেন থাকার আস্তানা। বড় একটা বাড়ি ভাড়া নেন বাবা। তার একতলায় বড় বড় ৬টি ঘর। শুরু হলো নতুন সংসার। মা ছিলেন অপূর্ব  সুন্দরী। এত ফর্সা রং দুধও যেন  কালো লাগতো। পুরীর মন্দিরে বিদেশি মনে করে মাকে সেবার ঢুকতে দেয়নি। রাগে দুঃখে মা কেঁদে ফেলেছিলেন, অভিমান করেছিলেন ঈশ্বরের ওপর। বাবা বলেছিলেন '   মানুষ তোমায় চেনেনি, ঈশ্বর কী করবেন! '

বাবার ডান হাতের অনামিকায় জ্বলজ্বল করতে নীলার আংটি। দাদু বড় ভালোবাসতেন নিজের এই  পরিশ্রমী বড় ছেলেটিকে। তাই রাজার কাছ থেকে যৌতুক পাওয়া নীলার আংটি মৃত্যুকালে ছেলেকে দিয়ে যান। মা ভয় পেয়েছিলেন, কারণ তিনি জানতেন এই পাথর বড় নির্মম। মা বলতেন,' এই পাথর ভালো হলে রাজা আর খারাপ হলে পথের ভিখারি।তুমি একে দূর করোও। কিন্তু বাবামায়ের এই অহেতুক ভয়কে হেসে উড়িয়ে দেন।

উত্তরপাড়া এসে বাবা কিছুদিন পর দিদির বিয়ে পাকা করলেন, ২ বছর পর হবে। মনীষা আর তার ভাইরা স্কুল কলেজে ভর্তি হয়, দিদি আর স্কুলে যায়নি। স্কুল আর সংসারের পাঠ মায়ের থেকে নিতে থাকে।

এর ভেতরে বাবা তার জমানো টাকায় ব্যবসা করতে শুরু করেন। মা বার বার  বারণ করেন,  বলতে থাকেন,' চিরকাল রাজকীয় ভাবে থাকা মানুষ তুমি,চাকরি করা মানুষের পক্ষে ৬০ বছরে গিয়ে ব্যবসা করে তাকে দাঁড় করানো এত সহজ কিন্তু  নয়। দোহাই তোমার এই পরিকল্পনা মাথায় এনো  না।' কিন্তু কোন পুরুষ কোনদিন নারীর বুদ্ধির কাছে  নিজের বুদ্ধিকে ছোট ভেবেছে! জমানো টাকা হুড়হুড় করে ঢালতে লাগলেন ব্যবসায়। লাভের বদলে লাভ তো দূর, লোকসানের পাল্লা ভারী হয়ে উঠলো। বাবারও কেমন জেদ চেপে গেল। এই করতে করতে জমানো টাকা প্রায় শেষের মুখে যখন মা তড়িঘড়ি করে দিদির বিয়েটা দিয়ে দিলেন।
'তোমার নীলাটা খুলে ফেলো, এই নীলা আমাদের সংসারে সর্বনাশ ডেকে আনছে। এখনো খুকুর বিয়ে বাকি, বড় ছেলেটা চাকরি খুঁজছে আর বাকি দুটো স্কুলে এখনো। '
 'কিছু হবে না গিন্নি, সব ঠিক হয়ে যাবে। এই আংটি মহারাজের দেওয়া। একি যে সে আংটি! এই আংটি কেউ হাত ছাড়া করে!'
কত রাতে বাবা মায়ের ঘর থেকে এই কথোপকথন কানে এসেছে মনীষার। দিদি চলে যাওয়ার পর ভীষণ একা হয়ে গেছে মনীষা। রাত জেগে লাইব্রেরি থেকে আনা বই আর সূঁচের কাজ করে সময় কাটে ওর।

কোন্নগরে আসার পর এই অন্ধকার বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসে মনীষার। দারভাঙ্গার প্রাসাদোপম বাড়িটা বা উত্তরপাড়ার গঙ্গার ধারের খোলামেলা বাড়িটা বড্ড টানে ওকে। কিন্তু উত্তরপাড়া বাড়ির শেষের কদিনের স্মৃতি ছিল ওর কাছে দুর্বিষহ। ব্যবসার ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে না পেরে একদিন বাবার হার্ট এট্যাক হয়, এবং ডাক্তার ডাকার সুযোগও পাওয়া যায়না। বাবা চলে যান অনন্তলোকে, রেখে যান দিশেহারা তাদের পরিবার আর শূন্য তহবিল। বড়দা হন্যে হয়ে একটা চাকরি খুঁজে চলেছে তখন, পরের ভাইদুটো নেহাতই ছোটো স্কুল যায় আর মনীষা আর তার মা সংসারের জোয়াল টানতে টানতে জেরবার। বাড়িভাড়া বাকি পরে যায় প্রায় ৬ মাসের। বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে সুমধুর সম্পর্কও তিক্ত হতে থাকে। প্রথম তিনমাসের ভাড়া বাকি থাকার পর ওনারা ইলেক্ট্রিসিটি কেটে দেন। লণ্ঠনের টিমটিমে আলোর মত হঠাৎই জীবনটাও আলো আঁধারি হয়ে ওঠে ওদের। একবেলা কোনো মতে রান্না হলে রাতটায় জলমুড়ি ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ৬ মাসের মাথায় বাড়িওয়ালা  তাগাদা দিতে থাকেন হয় উঠে যেতে হবে নাহয় বাড়ি ভাড়া মিটিয়ে দিতে হবে। একগলা ঘোমটা টেনে মা কাকুতি জানান, আরো কিছু সময়ের। বড়দার চাকরির দিকে তাকিয়ে মনীষার গোটা পরিবার। আর সারা কলকাতা  ঘুরে একটা চাকরি খুঁজে হয়রান বড়দা কলকাতা থেকে উত্তরপাড়া হেঁটে বাড়ি ফেরে রোজ, বাঁচানো পয়সায় অন্ততঃ চাল ডাল ফুটিয়ে নেওয়া যাবে।

এমনি একদিন সকালে মনীষার ঘুম ভাঙে ঢেঁড়া পেটানোর আওয়াজে, বাড়ির সব হাঁড়ি কলসি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বাড়িওয়ালার লোক রাস্তায়, ট্রাঙ্ক, খাতা বই সব রাস্তায় ছিটকে পড়ে, বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন বড়দাকে,' সতীশ এক্ষুনি বাড়ি ফাঁকা করে দিতে হবে, একটা জিনিসও আর এক মুহূর্তের জন্য বাড়িতে থাকবে না', মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে বড়দা। আগেই মনীষার চোখ মাকে খুঁজল, দেখলো রাস্তার এককোনে বাবার ছবি বুকে আঁকড়ে ঘোমটা টেনে মা দাঁড়িয়ে আছেন, আর ভাইরা ছড়িয়ে পড়া সংসার গুছিয়ে তুলতে ব্যস্ত।

মাথায় যেন আগুন জ্বলে গেল মনীষার। এত অপমান, এত লজ্জা! দৌড়ে গেল বাবার ঘরে, বাবার আলমারির ডানদিকের কোনে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো পাথরটা। রূপো বাঁধানো বেড় আগেই বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়েছে। হাতে জ্বল জ্বল করছে নীল রঙের পাথর, কী তার দ্যুতি ,কী তার জৌলুস!  বাবার মৃত্যুর পর মা বার বার বলে এসেছে  গঙ্গায় ফেলে আসতে এই অপয়া পাথরটাকে। মনীষা লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন।
আজ বের করে হাতের মুঠোয় নিয়ে সোজা চলে গেল বাড়িওয়ালার বোবা কালা ছেলের ঘরের সামনে। তার খেলনার হাজারো রঙ্গীন পাথরের ভীড়ে মিশিয়ে দিলো অপয়া পাথরটাকে। ঠোঁটের কোণে কোথাও একটা প্রতিহিংসার হাসি শুধু বিধাতপুরুষের দৃষ্টি এড়ালো না।

 ভাবনায় ছেদ পড়লো মায়ের ডাকে , 'খুকু যা  বাসনগুলো পিছনের পুকুরে মেজে নিয়ে আয়ে 'কোন্নগরে এই ছোট বাড়িটার সন্ধান দিয়েছিল বড়দার এক বন্ধু। তিনিই ওদের উত্তরপাড়া থেকে এনে এই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। ভাড়া ন্যূনতম, সেটা তিনিই প্রথম মাসে দিয়ে দিয়েছিলেন।  ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর তখনো কাটেনি সবার, লজ্জায় আর অপমানে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত সবাই। কোথায় দ্বারভাঙ্গার বাড়ির ইয়া বড় বড় ঘর আর কোথায় এই পুকুরপাড়ের সাতঘর এক উঠোন।

দিনগুলো কেটে যায় পরস্পরের গায়ে গায়ে, রোজকার যুদ্ধের সাময়িক বিরতি নিয়ে আসে বড়দার চাকরি। হারিয়ে যাওয়া সুখ, আর হাসি হঠাৎ করে যেন কোন্নগরের বাড়িতে এক সন্ধ্যায় ফিরে আসে। হই হই করতে  করতে বড়দা খবর নিয়ে আসে চাকরির। বড়দার চাকরির দুই মাসের মাথায় এই বাড়ি ছেড়ে মনীষারা সবাই বালিতে চলে আসে। এই বাড়িটা অপেক্ষাকৃত  বড় আর খোলামেলা। দু ঘর ভাড়াটে যদিও, কিন্তু কাড়াকাড়ি করে জীবন কাটাতে হয়না। মনীষা আবার কলেজে যাতায়াত শুরু করে। ভাইরাও পড়াশোনা আর স্বাভাবিক জীবন ছন্দে ফিরে আসে।
এত কিছুর ভেতরে মনীষা ভুলতে পারেনা নিজেদের অপমান, এক পাড়া লোকের সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে ঘটি বাটি কুড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়া। ভুলতে পারেনা ৮ বছরের ছেলের খেলনার ভেতরে অভিশপ্ত নীল পাথর ঢুকিয়ে আসা। রোজ অপেক্ষা করে প্রতিবেশীদের থেকে কোনো বিপর্যয়ের ঘটনা শোনার। কলেজের তিনতলার জানলা দিয়ে এখনো দেখা যায় সেই বাড়ি। না চাইলেও চোখ চলে যায় বারবার।

এমনই একদিন শরতকালে আকাশ কালো করে মেঘ আসে, ভর দুপুরে অন্ধকার নেমে আসে পাড়া জুড়ে। বাজ পড়ার শব্দে সবার বাড়িতে শাঁখ বাজতে থাকে। কলেজের তিনতলার সিঁড়ি থেকে মনীষা দেখে বাড়িওয়ালার ছেলে তখনো দোফলা আমগাছে চড়ে আম পাড়ছে। নিমেষে কী যেন হয় মনীষার! ছুটতে ছুটতে ওপর থেকে নেমে  যায়, রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছায়  গাছের কাছে।  চিৎকার করে ডাকতে থাকে,' পিন্টু নেমে আয়ে, ,বাজ পড়ছে।' বোবা কালা ছেলের কানে না বাজের শব্দ না মনীষার আওয়াজ, কোনোটাই পৌঁছায় না । কিন্তু মনীষাকে দেখে চিনতে পেরে পিন্টু  ততক্ষণে নেমে এসেছে গাছ থেকে। ওর একটা হাত নিজের হাতের ভেতরে ধরে মনীষা ছুটতে থাকে কলেজ বিল্ডিং এর দিকে। ঠিক তখনই জোরে একটা বাজ পড়ে ফেলে আসা আমগাছের ওপর, নিমেষের ভেতর ফলন্ত আমগাছ পুড়ে  ছাই  হয়ে যেতে থাকে। ভয়ে মনীষাকে জড়িয়ে ধরে ছোট প্রাণ।

পকেটভর্তি পাথরের ভেতরে তখনো নীল রংয়ের পাথরটা, মনীষার নজর এড়িয়ে । আকাশ ভেঙে বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় চারপাশ। পুড়ে যাওয়া গাছ আর প্রতিহিংসার হৃদয় ভিজে ওঠে একসঙ্গে।