যুদ্ধ আর মহামারী কি জন্য দুটি প্রায় সমার্থক শব্দ, কোভিডের দিনগুলো তা প্রতি মুহূর্তে বলে দিচ্ছে। সংক্রমণের সুনামি দেশের পর দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাসের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধে ক্যাসুয়ালটি সবচেয়ে বেশি প্রান্তবাসী মানুষজন। পেটের ক্ষিদে তাদের পায়ে ১৫০০ মাইল হাঁটার রক্তচিহ্ন এঁকে দিচ্ছে। অবসন্ন মা কোলে কাঁখে বয়ে চলেছে মৃত শৈশব। সুযোগসন্ধানী পুঁজি কৃষিউৎপাদনের পদ্ধতি পাল্টে ফেলছে বহুজাতিকের অনুকূলে। পাল্টে যাওয়া শ্রমআইন জানান দিচ্ছে, শিকাগোর হে মার্কেটের লড়াই ফিরিয়ে আনার সময় হল। এই সেই ক্রান্তিকাল, যখন আমাদের আশ্রয় খোঁজার দিন সেই গান কবিতা, নাটকের ঘরে দুয়ারে, যা যুগে যুগে শেকল ভাঙতে শিখিয়েছে। আজ বেশি করে মনে পড়ছে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে।
তাঁকে নিয়ে আলোচনায় একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ চলে আসে। চলে আসে সাধারণভাবে বাংলা কবিতার কথা। বাংলা কবিতার সঙ্গে আমার আদিপরিচয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ক্লাসে মহারথী শঙ্খ ঘোষের তত্ত্বাবধানে। তাতে প্রথম দর্শনে প্রেমটাই স্বাভাবিক ফলাফল। তারপরে লালপাহাড়ির কবি অরুন চক্রবর্তীর চ্যালাগিরির সুবাদে অনেক কবির সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সুযোগ হল। আর বিনিময় হল কবিতা ভালোবাসা, না ভালোবাসা এবং কখনো কখনো কবিতা, বা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, আধুনিক বাংলা কবিতাকে ঘৃণা করা বহু মানুষের সঙ্গে।
সেই বিনিময়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমার অনুভব যে কবিতা - সাহিত্যের এই ছন্দবদ্ধ পদাবলী যখন থেকে জন্ম নিয়েছে, তখন থেকে এই মায়াবী সন্তানের প্রতি মানুষের কৌতূহল ও নির্লিপ্তি, প্রশ্রয় ও সন্দেহ, বৈরাগ্য ও ব্যাকুলতার পরিমাণ প্রায় সমান সমান। এরা একে অপরের বিরোধী, কিন্তু সেই পরস্পরবিরোধী উপলব্ধিগুলো, যারা প্রতিদিনের বাস্তব জীবনে রেল লাইনের মত সমান্তরাল হয়ে চলে, তারা কবিতার কাছে এসে, তার ভেতরে ঢুকে একেবারে জড়াজড়ি করে ফেলে নিজেদের। তখন তাদের আলাদা করে ফেলাটা অসম্ভব। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে।
তখন স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলছে। সালটা১৯৩৬ সদ্য মৃত্যু হয়েছে কবি ফ্রেদেরিকো গারসিয়া লোরকার। চারদিকে বারুদগন্ধ। মাদ্রিদে টাঙ্গানো হয়েছে ফেস্টুন, তাতে লেখা নো পাসারেন। They shall not pass. সেই প্রেক্ষিতে কবি ম্যানুয়েল আলাতোলাগুয়েরো মনে করলেন একটি কবিতার বই ছেপে ফেলা একান্ত জরুরি। তাঁর একটি নিজস্ব ছাপাখানা ছিল, যদিও ততদিনে তা কিছটা ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু কাগজের আকাল। সেই তাগিদে যুদ্ধক্ষেত্রে জমা জঞ্জাল, যার মধ্যে ছিল পরাজিত শত্রুর ছেঁড়া পতাকা থেকে মৃত সৈনিকের রক্তাক্ত টিউনিক, তাই দিয়ে তৈরি হয়ে গেল কাগজ। তার যুদ্ধবিধ্বস্ত ছাপাখানায় সৈনিকেরা আনাড়ি হাতে হরফ সাজিয়ে তৈরি করে ফেলল পান্ডুলিপি। ছাপা হল বই। তারপর স্পেনের বিপ্লবী জনসাধারণ ও সৈনিকের হাতে হাতে ছড়িয়ে পরল সেই বই যার নাম Espanta en et Corazon বা Spain in my Heart. যুদ্ধ আর মৃত্যুর সঙ্গে সহাবস্থান করল জীবনের জয়গান। সেই কবির বই পাওয়া গিয়েছিল অন্তিম মুহূর্তে চে গুয়েভারার পকেটে - চে তাতেই নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন তাঁর পরিতৃপ্তির মন্ত্র। সে কবির নাম পাবলো নেরুদা। যিনি বিশ্বাস করতেন কবিতা একটি Social art.
বাংলা সাহিত্যে, কবিতার অঙ্গনে যে কজন কবি কবিতাকে এই উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন ও পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির কবিদের একজনের নাম নিঃসন্দেহে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রাজনীতির ঘূর্ণিঝড়, সাম্য ও স্বাধীনতার উচ্চারণ তাঁর কবিতাকে শরীর দিয়েছে অনেকটাই। তাই নামটির উচ্চারণ এক মুহূর্তেই আমাদের মনের ক্যানভাসে এঁকে ফেলে চওড়া কপাল, উন্নতশির এক মানুষের মুখ, দৃষ্টি যার নিবদ্ধ এমন এক সূর্যের উদয়ের দিকে, যার ছটা সমানভাবে পড়বে সমাজের তথাকথিত ওপরতলার মানুষের সঙ্গে ন্যাংটো খুকুর নোংরা বিছানায়। আবার এটাও তো সত্য যে 'the poet laureate of the masses is also the poet of empty space.' সে empty space কখন ভরে যায় প্রেমে, গভীর বন্ধুতায়, কখন আত্মপলব্ধির মগ্ন উচ্চারণে, এমনকি ঈশ্বরচিন্তায়। তিনি লিখে ফেলেন
আমি অনেক হৃদয় দেখলাম/ তোমার মত গভীর কেউ না
আমি অনেক কবিতা জানলাম/ তোমার পলিমাটির মত না
আমরা তো জানি একথা, যে নেরুদা একসময় টানা একশোটি সনেট, একশোটি প্রেমের কবিতা লিখে উৎসর্গ করেছিলেন প্রিয়তমা মাতিলদে উপসিয়াকে। আসলে প্রেম প্রতিবাদ প্রকৃতি সব মিলেই বেদনাময় পৃথিবীতে রচনা করে কোনায় কোনায় নীল স্বপ্নভরা অট্টালিকা। সেই অখণ্ড জীবনের আরাধনাতেই প্রাণ পায় সার্থক কবির সৃষ্টি। এ দর্শনে গভীর বিশ্বাস রাখতেন বীরেন্দ্র। তাই প্রতিবাদ আর প্রেম যেন খুব স্বাভাবিকভাবেই পাশাপাশি বাস করে তাঁর কবিতায়। তিনি যখন বলছেন
যোদ্ধার হৃদয় বলে কিছু নেই?
নেই পিছুটান ?
যেখানে সন্ধ্যাবাতি জ্বলে, শিশুকোলে
মানবী ছায়ার মতো - শীর্ণ প্রতীক্ষায়
বন্দুকের নল ছাড়া তার চোখে আর কোন স্বপ্ন নেই ?
তখন এই বিশ্বাসেরই প্রতিধ্বনি শুনি আমরা।
বাংলা সাহিত্যের পাঠক ও গবেষকের কাছে ছোট পত্রিকার কবি বলে তিনি পরিচিত। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত বাজারি বড় পত্রিকা প্রসাদ পায় নি এ কবির। একবারে শেষজীবনে, ক্যান্সার আক্রান্ত কবি ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালের বেডে শুয়ে লেখা দুটি কবিতা একটি বড় হাউসে ছাপানোর অনুমতি দিয়েছিলেন। আসলে সেই পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন পড়েনি তাঁর। নিজগুণেই তাঁর কবিতা স্থান করে নিয়েছে পাঠকের অন্তর বেয়ে ইতিহাসের কুঠুরিতে। আমার তো মনে হয় আজ থেকে কয়েক দশক বা শতক পরেও দেখা যাবে মানুষ প্রায় প্রবাদের মতই উচ্চারণ করছে
রাজা আসে যায়, রাজা বদলায়
বা
কালো রাত কাটে না, কাটে না।
এত ডাকি, রোদ্দুর এই পথে হাঁটে না।
এই যে বললাম নিজগুণ, আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সেই গুণের খোঁজ করা যাক একটু।
কবি নিজের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, এবং বেশ আক্ষেপের সঙ্গে বলছেন
'ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধরে
একটা বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটা গাছ জন্মাতে পারত।'
এই কটা লাইন আমাদের কয়েকটা খবর দেয় তাঁর কবিমানসের।
এক; কর্মী, অর্থাৎ যাদের কাজের প্রত্যক্ষ ফলের অংশীদার হতে পারে মানবসমাজ, তাদেরকে তিনি এগিয়ে রেখেছেন সবার আগে।
দুই; তাদের জীবনের যন্ত্রণার অনুভবটা তাঁর অন্তরের অনুভব। এইটা বুঝতে গেলে তাঁর জীবনে রাজনীতির অনুশীলনের রুপরেখাটার দিকে চোখ রাখতে হবে আমাদের। কৈশোরে অনুশীলন সমিতির সভ্য ছিলেন। এর পরে অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির প্রাথমিক সদস্যপদ নেন। কিন্তু অল্পদিনেই তা ছেড়েও দেন। সমাজতন্ত্রে, মারক্সীয় দর্শনে তিনি আজন্ম বিশ্বাস রেখেছেন বটে, কিন্তু কোন দলের শেকলে তাকে বাঁধতে দেননি। কারণ স্বাধীনতার সময় থেকে সি পি আই এর সব ভূমিকাকে তিনি নির্দ্বিধায় সমর্থন করতে পারেন নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও ব্রিটেন রাশিয়ার সমর্থক হবার কল্যাণে ব্রিটেনের প্রতি প্রশ্রয়ের মনোভাব পোষণ করতে হবে, বা রাশিয়ার প্রতিটি নাগরিক দেবদূতের সমান, বিশ্বের মুক্তিতে সেই একমাত্র মেসিহা এরকম সিদ্ধান্তের সমর্থন করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা তাঁর ছিল না। তাই প্রথম বিশ্বের দ্বারা তৃতীয় বিশ্বের শোষণ বঞ্চনা তাকে যেমন উদ্বেল করেছে, তেমনি পোল্যান্ড বা চেকোস্লোভাকিয়ায় এবং আরো পরে আফগানিস্তানে রাশিয়ার ভুমিকা, বা খোদ বাংলার বুকে জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনে বামফ্রন্ট সরকারের ভুমিকা কিছুরই বিরোধে নামতে, কোন দ্বিধার শিকার হননি। অর্থাৎ দলীয় মতাদর্শের চশমা পড়ে নয়, সাদা চোখে নিপীড়নের যে চেহারাটা তিনি দেখেছেন, তাকে অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন। আর সেই অনুভূতির বীজ তিনি যখন কবিতার মাটিতে বুনেছেন, জন্ম নিয়েছে হিরন্ময় শস্য। সে সোনালী ফসলের খামারে তখন কবিতার এক অন্য ভাষা জন্ম নিয়েছে, জন্ম নিয়েছে অন্য প্রতিবাদ। শঙ্খ ঘোষ যাকে বলছেন 'রিক্ততার নতুন ভাষা'।
বীরেন্দ্র যখন প্রায় শুরুর দিকে, তখন বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাস থেকে বেড়িয়ে আসতে চেষ্টা করছে। মাফ করবেন, সর্বগ্রাস কথাটা কঠিন ঠেকতে পারে, কিন্তু এটি ব্যবহার করেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ স্বয়ং। সে যাই হোক, উত্তর চল্লিশ বা পঞ্চাশের কবিরা আন্তরিক চেষ্টা করছেন একটা নতুন ক্ষেত্রে পা ফেলতে। দেখা গেল, সে চেষ্টায় সে সময়ের অগ্রণী কবিদের যেন প্রধান হাতিয়ার মেধা। না বোধ নয়, অনুভব নয়, মস্তিষ্কের পেশীশক্তি যেন সম্বল। আর একটা মোড়ক, একটা চকচকে মোড়ক, যেন ড্রয়িংরুমের সাজানো সংসার।
'বড় বেশি শৌখিন বাতাস বয়
ধ্রুপদী কবির বাহবায়, ছন্দে উপমায়
ত্রিকোণ শব্দের বিস্ফোরণে।'
সেই বাহবার ভাষা থেকে বেড়িয়ে প্রথম সার্থকভাবে একটা সহজ স্বপ্নের ভাষার সন্ধান দিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাস। আর এক ধাপ এগিয়ে প্রায় আটপৌরে উচ্চারণে তাঁর কবিতাকে বীরেন্দ্র দাঁড় করান দৈনন্দিনতার সমতলে। আর সেই সহজিয়ার আবেদনে প্রতিবাদের শব্দ আমাদের কানে মন্ত্রের মত বাজে
অন্ন বাক্য, অন্ন প্রাণ, অন্নই চেতনা
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা
অন্ন অগ্নি বায়ু জল, নক্ষত্র সবিতা
অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত্য অন্নই ওঙ্কার
সে অন্নে যে বিষ দেয় কিম্বা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো ধ্বংস করো ধ্বংস করো তারে।
এই যে অনুভূতির গাঢ় সংবেদ, কবি যাকে বলেন অনুভূতিদেশ থেকে আলো -
মানুষের মন তবু অনুভুতিদেশ থেকে আলো না পেলে
নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ;
এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল।'
সেই আলো কমবেশি জড়িয়ে থাকে তাঁর প্রায় সব কবিতায়, এমন কি গদ্যেও।
তবে অনুভুতিদেশ থেকে উঠে আসা এই যে আলো, আমার মনে হয় তা দুটো মাত্রা নিয়ে প্রকাশ পায় তাঁর কবিতায়। প্রতিবাদের সহজ অথচ স্পষ্ট উচ্চারণ যেমন এর একটা ফল, তেমনি তিনি অবচেতনেরও কবি। সেই অবচেতন থেকে উঠে আসা বোধ কখন স্পষ্টভাবে, কখনো বা অলক্ষ্য বাতাসের মত ছড়িয়ে থাকে, জড়িয়ে থাকে তাঁর কাব্যকৃতির গায়ে। ঘুম স্বপ্ন আর বুকের গভীরের কথা মিশে যায় কান্না ঘাম রক্তের বাস্তবতার সাথে। আর তাতেই তাঁর লেখায় বাস্তবতার বিবরণের উত্তরণ ঘটে কবিতার মায়াপৃথিবীতে।
শঙ্খ ঘোষ যথার্থই বলেন স্লোগান তাঁর হাতে মন্ত্রের শরীর পায়। কবিতায় স্লোগান নয়, স্লোগানকে কবিতায় পরিণত করেন বীরেন্দ্র।
সবশেষে এর একটা উদাহরণ দিয়ে আজকের লেখায় ইতি টানি। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ রানুর জন্য প্রকাশ হয়েছে। তার দোল ও পূর্ণিমা কবিতায় একটা পংতি লিখলেন
'একাকী যুবতী চাঁদ মাঝরাতে ফাঁকা ট্রেনে চুরি করে দুর্ভিক্ষের চাল'।
পংতিটা পড়ি, আর সপাং করে চাবুকের শব্দ শুনি যেন। নষ্ট সময়ে কবির চাঁদও নেমে পড়ে চৌর্যবৃত্তিতে, স্বভাবে নয়, অভাবে। চাঁদের আগে যুবতী - এই বিশেষণটি প্রয়োগ করে কবি যেন বুঝিয়ে দেন যৌবনের বিনস্টির কথা।
ফাঁকা ট্রেনে তার একাকী বিচরণ, তাও কিনা মাঝরাতে, দেয় তার সুযোগসন্ধানী চরিত্রের ইঙ্গিত, কিন্তু অভিসারের রোমাঞ্চ নয়, এক কুন্ঠিত তস্করের মালিন্য লেগে থাকে সে বিচরনের গায়ে। সে বিচরণ তো কোন অমৃতের সন্ধানে নয়, তার সবটা যে নিয়োজিত থাকে কয়েক দানা চালের জন্য।
এরা থাকে একাকী, সবার নীচে, সবার পিছে। কেননা সমষ্টির ব্যাপ্ত অভিজ্ঞতায় উত্তরণের কোন দায় নেবার জোর যে তাদের নেই। চেতনের অলক্ষ্যে এরা একাকী বাঁচে, একাকীই মরে। আর এই একাকীর আত্মহনন কবি প্রত্যক্ষ করেন তীব্র বেদনায়, আর তারপর তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসে আমাদের চেতন ও অবচেতন মনের দুকূল ছাপানো এই বাণী।
দুর্ভিক্ষের ক্ষয়িষ্ণু ছবিটা শুধু পেটের ভেতরকে নয়, দেশের যৌবনকেই গ্রাস করে ফেলছে, এমন ধ্বংসচিহ্নের উপস্থিতি কি অমোঘ হয়ে ওঠে মাত্র দশটি শব্দের এক পংতিতে।
এইখানেই বীরেন্দ্র ছাপিয়ে যান তাঁর সমসাময়িক অন্য কবিদের। কোন বড় হাউসের পৃষ্ঠপোষকতা লাগে না তাঁর। আলোর মত, হাওয়ার মত দশ দিকে তাঁর কবিতার উপস্থিতি টের পাই আমরা। সেই উপস্থিতিকে উদযাপন করতে আসুন, আজ সকলে উচ্চারণ করি
এক জোনাকি, দুই জোনাকি, তিন জোনাকি জ্বলে
পায়ের তলায় মাটি পেলেম, আপনি ছিলেন বলে
এক জোনাকি, দুই জোনাকি, তিন জোনাকি আসে
আপনি শক্তি দিতেন আমার দারুণ সর্বনাশে
এক জোনাকি, দুই জোনাকি, তিন জোনাকি যায়
রাস্তা আমরা খুঁজে পেয়েছি আপনারই দয়ায়
আপনি ছিলেন আপনি আছেন আমাদের অন্তরে
তবু জোনাক জ্বলে জোনাক নেভে, মন যে কেমন করে।
আজকের বিপন্ন বন্ধ্যা সময়ের নিষ্ফলা মাঠে তাঁর কবিতার শস্য আমাদের বেঁচে থাকার, নিশ্চিন্ত হবার আশ্বাস দেয়।
অফলা মাঠে নবীন শ্যামল ঘাসে
উপচে পড়া ফসলে পৃথিবী ভাসে
হৃদয়লীন বেঁচে থাকবার আশে।
নিভাঁজ নরম তোমার কোলে
বিক্ষত দিন রোদে মুছে ফেলে
ঘুমিয়ে আমার চোখ।
তখনো তুমি অঘুম, অপলক।