সন্ধ্যা নেমে আসছে, কোটি কোটি বছর ধরে যেভাবে সন্ধ্যা নেমে এসেছে আজও সে ভাবেই সন্ধ্যা নেমে আসছে। কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে আকাশের কোণে কোণে ছায়াপথ ধরে ফুটে উঠছে একটা দুটো তারা।
পাহাড়ের বিকেল...দুপুরের থেকেও আমাকে বেশি আকর্ষণ করে পাহাড়ের সন্ধ্যা। একা একা হোটেল থেকে বেরিয়ে অন্য কোনও দূর-পাহাড়ের ঢালের দিকে তাকাই, একটা-দুটো করে ফুটে উঠছে আলো। দিনেরবেলা যে পাহাড়ের ঢালকে মনে হয়েছিল শুধুই জঙ্গলে-ঢাকা এক কচ্ছপের পিঠ, সেখানেও ফুটে উঠছে রহস্য।
সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয় এই ব্রহ্মাণ্ড কি তা হলে এক শূন্যতার পাহাড়? যার এক ঢালে আমরা... মাঝে মাঝে অন্ধকারে অন্য ঢালের দিকে তাকাই আর খুঁজে পাই রহস্যের ইশারা! এই তারার দল, যেন পাহাড়ি স্কুলের ছেলেমেয়ে... এক বাঁক পেরিয়ে দেখা হল... পিঠে স্কুলের ব্যাগ। ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে তারা।
মানুষের সব থেকে বড় অর্জন, তার মাথার ওপর চিরদিন ফুটে থাকা হাজার হাজার তারা। এত তুচ্ছ আর নগণ্য সে, কিন্তু তার মাথার উপর ধকধক করছে বিপুল বস্তুপুঞ্জের ভার... আলো। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠতে পারে, ‘আজি এত তারা তব আকাশে...’
দু’বার নোবেল-বিজেতা বিজ্ঞানী লিনাস পাউলিঙ-এর ‘সায়েন্টিস্টস ইন পলিটিক্স’ প্রবন্ধটি পড়ছিলাম। লিনাস লিখছেন, ‘I am hopeful for the future. I believe that nuclear war can be avoided, and that, in the course of time, the institution of war can be abolished. I hope that the present unjust distribution of world’s wealth can be rectified, in the course of time, by peaceful method, through the process of evolution of the existing political and economic systems…’
ছ’লক্ষ মেগাটন ক্ষমতাসম্পন্ন (প্রকৃত চিত্রটা হয়তো আরও খারাপ) পারমাণবিক মারণাস্ত্রে ভরে থাকা পৃথিবীর উপর বসে এক ব্যথিত বিজ্ঞানী ভাবছেন, আগামী দিনে পৃথিবীর ‘যুদ্ধ-প্রতিষ্ঠানগুলি’ অবলুপ্ত হয়ে যাবে, পৃথিবীতে অসাম্যের দিন শেষ হয়ে আসবে। কারণ তিনি জানেন, ‘পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ১০ শতাংশ অতিরিক্ত যদি বরাদ্দ করা যায়, তা হলে শুধু উন্নয়ণশীল দেশেরই নয় – এমনকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র-সহ উন্নত দেশগুলিতে বসবাস করা গবীর মানুষগুলোর প্রতিদিন বেঁচে থাকার দুর্দশাকে প্রায় দূর করে ফেলা যাবে…।’
২
জীবনের কুড়ি-একুশ বছর বয়সে তীব্র এক কবন্ধ ভয় গ্রাস করেছিল জয় গোস্বামীর ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ কাব্যগ্রন্থের ‘সমস্ত শ্মশানবন্ধুকে’ কবিতাটি পড়ে… রাত্রি হলেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছেয়ে থাকত সেই গা-ছমছম করা অনুভুতি, ‘ধায় রাত্রি ধায় রাত্রি মাতৃধারা যায় যে গঙ্গায়…’
একই বিস্ময়ে প্রতিটি স্নায়ু ঝনঝন করে ওঠে যখন স্টিফেন হকিং-য়ের কথাগুলি মাথার ভিতর নিয়ে রাত্রের আকাশের দিকে তাকাই, ‘If the rate of expansion one second after the big bang had been smaller by even one part in a hundred thousand million million, the universe would have recollapsed before it ever reached its present size.’ কী সম্ভবাতীত সম্ভাবনার পথ বেয়ে একটি গ্রহের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে মানুষ! চারদিকে সংকেত-দেবতার হাসি, ‘Why is the universe the way we see it?’ The answer is then simple: If it had been different, we would not be here!
এই সম্ভবাতীত সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে মনে হতে বাধ্য, আমাদের এই ‘দেখা’র ক্ষেত্রটি প্রস্তুত হতে শুরু করেছিল সেই মহা-বিস্ফোরণের সময় থেকেই। এক অনিবার্যতার পথ বেয়ে আমরা এসেছি।
সেই অনিবার্যতার পথ বেয়েই এসেছে রবীন্দ্রনাথের গান। ‘গীতবিতান’-এর পাতা খুলে একবার দেখে নেওয়া যাক একটি গান, ‘আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি জ্বলে / নিদ্রাবিহীন গগনতলে’।
সেই ‘আলোক-মাতাল স্বর্গসভার মহাঙ্গন’ একদিন নিমন্ত্রণ জানিয়ে ছিল। কিন্তু সেখানে তো মাটির গন্ধ নেই। সবুজের স্পর্শ নেই। তাই কবি চলে আসছেন সেখান থেকে, প্রত্যাখ্যান করছেন সে-আমন্ত্রণ। কবির মন পড়ে আছে ‘শ্যামল মাটির ধরাতলে’। এখানে একটি লেবুর মতো ছোট্ট পৃথিবীতে রঙিন ফুলের আলিম্পন, আঁধার-আলোর আলিঙ্গন-’
আমি অসীম থেকে স্বেচ্ছায় সীমার বাঁধনে নিজেকে বন্দি করেছি; এবং করেছি বলেই সীমা থেকে অসীমের দিকে চলে যেতে আমার কাছে একটি মাত্র মুহূর্তের অবসরই যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া কেই বা এমন সহজ করে বোঝাত যে, মহা-বিস্ফোরণের সময়েই আমাদের জন্ম শুরু হয়েছিল!
হায়, যে পৃথিবীতে পরমাণু-অস্ত্র তৈরি হয় সেই পৃথিবীরই কেউ অ্যন্থ্রোপিক প্রিন্সিপ্যালের কথা ভাবে, সেই পৃথিবীতেই গান বাঁধেন রবীন্দ্রনাথ…