বেলাফন্টে নিয়োগীজি ও পরিযায়ী শ্রমিক - পার্থজিৎ চন্দ

একটি খুপরি ঘর থেকে বারান্দা– এই পৃথিবীর মধ্যে দিনের পর দিন কাটাতে কাটাতে আমাদের অনেকেরই শরীরের ভিতরে টিকটিক করে ঘুরতে থাকা ঘড়ির কাঁটার চলন বদলে গেছে। এক ছোট্ট ভাইরাস সারা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে জেলখানার জীবন উপহার দিয়েছে।
নির্ঘুম রাত্রে অনেক গানের সঙ্গে আমার প্রিয়তম আশ্রয় বেলাফন্টে, তাঁর ব্যানানা-বোট মেরি’জ বয় জামাইকা ফেয়ারওয়েলের ঘোর থেকে আমি এক জন্মে মুক্ত হতে পারব না। সে দিনও শুনছিলাম ‘কাম মিস্টার ট্যালি ম্যান, ট্যালি মি ব্যানানা…’। একদল শ্রমিক জাহাজে কলার সার তুলে দিয়ে ভোরের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফিরতে চাইছে। তাদের ঘামে ভেজা শরীর থেকে ভেসে উঠছে গান, ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রের বুকে।
জামাইকা থেকে ঔরঙ্গাবাদের জলনা – সব শ্রমিকই তো একটা সময় ঘরে ফিরতে চায়। পরের দিন টিভি-চ্যানেল খুলে চমকে উঠেছিলাম। আমরা যারা অনেকে এই অতিমারির দিনে- দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান নিয়ে যাদের কপালে এখনও ভাঁজ পড়েনি– তারা ঠিক কতটা বুঝবে, কী অসহায়তা নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের দল বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি ফেরার জন্য!
আমি যে সময়ে ‘ব্যানানা-বোট সঙ’ শুনছিলাম, রাত ভোর হয়ে আসছিল, তখনই পরিশ্রান্ত একদল শ্রমিক করমাড নামে একটা যায়গায় রেললাইনে মাথা রেখে ‘নিশ্চিন্তে’ ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ষোলটি দেহের উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল মালগাড়ি। কী অপরিসীম শ্রান্তি আর ক্লান্তি থাকলে মানুষ মালগাড়ি ছুটে আসার শব্দ শুনতে পায় না সেটা ভেবে শিউরে উঠতে হয়।

অতিমারি কেড়ে নিচ্ছে অনেক মুখ। অতিমারি কি মিছিলের মুখও কেড়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে?
 ষোল জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর সঙ্গে এই ভাবনার হয়তো অতি ক্ষীণ একটি যোগসূত্র আছে।
 ঠিক যেমন বেলাফন্টের ‘ব্যানানা-বোট সঙ’ শুনলে, শ্রমিকদের দৃপ্ত স্বর শুনলে অদ্ভুতভাবে মনে পড়ে নিয়োগীজির শেষদিনগুলির কথা। ১৯৯১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভোররাতে গুলি করে হত্যা করা হয় প্রবাদপ্রতীম শ্রমিকেনেতা শংকর গুহ নিয়োগীকে। শোনা যায় তার অনেক আগে থেকেই, খুন হতে পারেন এমন একটা আভাস পেয়েছিলেন তিনি।
শংকরজির শেষযাত্রায় দেড়-লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছিল বলে জানা যায়। শংকরজির মত ও পথ নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। সংঘর্ষ ও নির্মাণ আসলে কী, সেটি সোনার পাথরবাটি কিনা সে তর্কে আমাদেরও বহুদিন কেটে গেছে। কিন্তু তাঁর হত্যার সঙ্গে সঙ্গে ছত্তিশগড়ের শ্রমিক-মহল্লাগুলিতে স্বতস্ফূর্ত বনধ পালন শুরু হয়েছিল, হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।
কোভিড-১৯ কি কেড়ে নিতে চলেছে এই জমায়েত আর মিছিলের অধিকার?
আমাদের পৃথিবীতে কোভিড এসেছে ঠিক সে সময়ে যখন সারা পৃথিবীর  ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছে একটু একটু করে। জাতিসত্তা  ধর্ম পুঁজি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সব একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে শুরু করেছে। তারা নিজেদের মতো করে নিজেদের মধ্যে স্পেস তৈরি করে নিচ্ছে, সুযোগ দিচ্ছে একে অপরকে বেড়ে ওঠবার। এখন প্রতিটি ক্ষমতাকেন্দ্রেরই দুটি করে মুখ – একটিতে সে অতি-প্রকাশ্য এবং অপরটিতে সে অতি-গুপ্ত। ভার্চুয়ালি আমরা রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে পারি। আক্রমণ করতে পারি। কিন্তু সারা পৃথিবীর কোটি কোটি শ্রমিক, যারা কাজ হারাবে এবং নিশ্চিত অনাহারের দিকে ঢলে পড়বে তাদের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কোনও সুরাহা বয়ে আনতে পারবে না।
যাদের কাজ থাকবে তাদের মন্দার জুজু দেখিয়ে অনিশ্চয়তা নামক বন্দুকের নলের সামনে রেখে কাজ করানো হবে। রিসেশনের থেকেও রিসেশনের ভয়কে বেশি করে চারিয়ে দেওয়া হবে। শ্রমিককে অধিকার ছিনিয়ে নিতে গেলে নেমে আসতে হয় রাস্তায়, কংক্রিট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভার্চুয়াল লড়াই আসলে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো একটি ব্যপার। রাষ্ট্র তার সব কিছু নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি কংক্রিট বিষয়।
শ্বেত-সন্ত্রাসে অভ্যস্ত রাষ্ট্র ও পুঁজি হয়তো এই অতিমারির সুযোগে মিছিল ও সংগ্রামের মুখটিকেই ভ্যানিশ করে দেবার চেষ্টা করবে। অতিমারির কারণে যে ফিয়ার সাইকোসিস তৈরি হয়েছে তাকে জিইয়ে রাখবার চেষ্টা চলবে পুরোদমে। করোনার প্রকোপ কমে এলেও, নিছক সঙ্গরোধ ভাঙা ও অতিমারির ছড়িয়ে পড়বার মধ্যে একটা সরলরৈখিক কার্য-কারণ সম্পর্ক টেনে দেওয়া হবে। পুঁজি ও ‘হোয়াইট কলার’ রাষ্ট্রশক্তিগুলির কাছে করোনা অভাবিত এক সুযোগ এনে দিয়েছে। কয়েক বছর এই ফিয়ার সাইকোসিস চালিয়ে যেতে পারলে আগামি কয়েক দশকের নিরুপদ্রব শান্তির নিশ্চয়তা।
করোনা ভয়াবহ এক ভাইরাস সন্দেহ নেই। কিন্তু করোনা আলাদিনের আশ্চর্য চিরাগও বটে কারও কারও কাছে। কোন রাষ্ট্র বা পুঁজি না দেখতে চাইবে যে গুটিকয়েক মানুষের মিছিল চলেছে... তাদের স্লোগানও আছে দাবিও আছে... কিন্তু সব চলছে এক সেফ-ডিস্টেন্স মোডে। দু’জন শ্রমিকের মধ্যে ওই যে সাড়ে তেরো ফুটের দূরত্ব ওখানেই তো পুঁজি আর ক্ষমতা মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে পারে নিশ্চিন্তে।
তার শরীরের ওপর দিয়ে মালগাড়ি চলে যাবার কোনও সম্ভাবনা নেই।