সে যুগের দিগম্বরী, ধর্মত্যাগী স্বামীকে ত্যাগ করা উচিত কিনা পণ্ডিতদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন...
সেই পুরুষশাসিত সমাজে তাঁর প্রতিবাদ। তবু তিনি নিন্দায় জর্জরিত হননি। হিন্দু সমাজ তাঁকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিল। অপরূপ লাবণ্যময়ী ছিলেন। লক্ষ্মীশ্রী বলতে যা বোঝায়। অবিভক্ত বাংলার যশোরের নরেন্দ্রপুর-এর মেয়ে। মাত্র ছয় বছর বয়সে দ্বারকানাথের ধর্মপত্নী হয়ে এলেন ঠাকুরবাড়িতে। তখন হাতেগোনা যে ক'টি অভিজাত পরিবার ছিল তার মধ্যে অন্যতম জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি। দুধে-আলতা গায়ের রং, কালো চুল, চাঁপাকলির মত হাতের আঙ্গুল আর অসম্ভব তেজ নিয়ে প্রবেশ ঘটেছিল ঠাকুরবাড়িতে। শাশুড়ি তাঁকে সমীহ করে চলতেন। তখনকার দিনে দ্বারকানাথরা ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব। আলাদা হয়ে যাওয়া পাথুরঘাটার ঠাকুরেরা বলতেন 'মেছুয়াবাজারের গোঁড়া'। পেঁয়াজ রসুন বাড়িতে ঢুকতো না। মাছ-মাংস নৈব নৈব চ। গৃহদেবতা লক্ষ্মী জনার্দন-এর পূজো করতেন দ্বারকানাথ। পুজোর যোগান দিতেন দিগম্বরী। তখন তাঁদের সুখী দাম্পত্য জীবন।
সে যুগের বাবুদের মত বিলাসী ছিলেন না দ্বারকানাথ। তাঁর ছিল উন্নত রুচি। তাঁর বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে ছিল নানা রকম প্রমোদের আয়োজন। অনেক টাকা খরচ করে বাগানবাড়িটি সাজিয়েছিলেন দ্বারকানাথ।ফোয়ারা, সেতু, বিলিতি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো, বাড়ির খবর ছাপা হয়েছিল সেদিনের কাগজে। নাচ-গান খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি দিয়ে বাড়ির উদ্বোধন হয়েছিল ।সময়টা ছিল ১৮২৩। এইসময় দ্বারকানাথ গভর্মেন্টের দেওয়ান ছিলেন। বিলাসিতা ও বাবুয়ানির ছদ্মবেশে নবযুগের ভাবনা বাসা বাঁধল দ্বারকানাথ এর ভেতর। ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি ও হচ্ছিল। সাহেব-সুবোর সঙ্গে মেলামেশা শুরু হলো। এই জন্য তাকে ছাড়তে হলো নিজের হাতে পুজো। নিত্য পুজোর জন্য ১৮ জন শুদ্ধাচারী ব্রাম্ভন নিয়োগ করলেন তিনি। শুধু তাই নয় তিনি নিজেই সেই সময় ব্যবসার প্রয়োজনে মাংস ও সেরি খাওয়াও শুরু করলেন।দিগম্বরী ও দ্বারকানাথের সংসারে উঠল ঝড়। দুজনের চলার পথের অভিমুখ বদলে গেল।
প্রথম প্রথম দিগম্বরী বুঝতে পারছিলেন না। কর্ম ব্যস্ত থাকতেন তিনি। বাড়িতে বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদা এসেছেন। তার বয়স মাত্র ছয়। ভোর চারটের সময় দিগম্বরীর পুজো শুরু হয়। তারপর লক্ষ হরি নামের মালা জপা শুরু। তিনি নিয়মিত পড়তেন 'ভাগবত 'ও' রাসপঞ্চাধ্যায়'। দয়া বৈষ্নবী পড়ে শোনাতেন নানা রকমের ধর্মগ্রন্থ। নিজেই রান্না করে খেতেন দিগম্বরী। একাদশীতে খেতেন ফলমূল।
এই ব্যস্ততার মাঝে শুনতে পান অনেক কথা। কিছু শোনেন আবার ভুলেও জান মালা জপতে জপতে । আবার নিজেকে শান্ত রাখেন এই ভেবে যে কৃতি পুরুষের গায়ে অনেকে কালি ছিটোয় হিংসে থেকে। কিন্তু বেশিদিন ভুলে থাকতে পারলেন না বাগানবাড়ির পানভোজন মির্জাপুরের কার্পেটে সজ্জিত বাড়ির আলো এসে পড়ল তাঁর অন্দরমহলে । অনেকে দ্বারকানাথের বাগানবাড়ির পানের আসর নিয়ে গান বেঁধেছিলেন সেই সময়।
"বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরিকাঁচির ঝনঝনি
খানা খাওয়ার কত মজা আমরা তার কি জানি
জানেন ঠাকুর কোম্পানি।"
বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষী শোনালেন
"কি মজা আছে রে লাল জলে
জানেন ঠাকুর কম্পানি
মদের গুনাগুন আমরা কি জানি
জানেন ঠাকুর কোম্পানি"
এরপর আর দিগম্বরী চুপ থাকতে পারলেন না নিজেই বেরিয়ে পড়লেন প্রকৃত সত্যি জানার জন্য। পতিব্রতা ভক্তিমতী দিগম্বরীরএই অতর্কিত অভিযান চির স্মরণীয় হয়ে আছে। সঙ্গে ছিলেন পুত্রবধূ সারদা এবং কিছু আত্মীয়া। চোখের সামনে দেখলেন আলো-ঝলমলে ঘরে সাহেব মেমদের সঙ্গে পানাহারে মত্ত দ্বারকানাথ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ভেঙে পড়লেন কিন্তু হাল ছাড়েননি। প্রাণপণ চেষ্টা করলেন দ্বারকানাথ কে স্বপথে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যর্থ হলেন। এইরকম দুঃসময়ে অন্য মেয়েরা কি করতেন কেঁদে ভাসাতেন , নয়তো আত্মহত্যা করতেন বা নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতেন পরিবারের কথা ভেবে ।দিগম্বরী যা করলেন ঊনবিংশ শতাব্দী বা পরবর্তী কালের মেয়েরা স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না। এই তেজস্বিনী রমনির কাছে ধর্ম ও কর্তব্য সবার আগে, তাই তিনি পন্ডিতদের দ্বারস্থ হলেন তাদের মতামত চাইলেন এমতাবস্থায় কি করা যাবে স্বামীকে ত্যাগ করে কুল ধর্ম বজায় রাখবেন নাকি স্বামীর সহধর্মিনী হয়ে কুল ধর্ম ত্যাগ করবেন? পন্ডিতরা জানালেন ভক্তি করা যেতে পারে কিন্তু সহবাস ইত্যাদি করা উচিত নয়। কেবলমাত্র সেবা ছাড়া সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। বাইরের কেউ কিছু জানলেন না। পরিবারের সম্মান রইল। এই বুদ্ধি বিচক্ষণতার পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন। প্রতিদিন স্বামীর পাশে গিয়ে মাটিতে একটি প্রণাম রেখে আসতেন একথা জানা যায়। আর বলাই বাহুল্য নির্বিকার ছিলেন দ্বারকানাথ । এই পর্যন্ত দিগম্বরীর প্রতিবাদ সমর্থনযোগ্য কিন্তু স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে হলে তারপর সাতঘড়া গঙ্গা জলে স্নান করা সমর্থন যোগ্য কিনা তা বিচার্য বিষয়। কিছুদিন পর দিগম্বরীর জীবন প্রদীপ নিভে গেল। বেঁচে থাকল ভক্তি ধর্ম এবং নিষ্ঠার কথা। স্বাধীনচেতা দিগম্বরীর এই চারিত্রিক দৃঢ়তা পরবর্তীতে নিশ্চিতরূপে বাংলাদেশের মেয়েদের সাহস যুগিয়েছিল ধরে নেওয়া যায়।