আশ্চর্য কবিতা

চণ্ডীপুরের ইংরাজি স্কুলে আমাদের ক্লাশে একটি নূতন ছাত্র আসিয়াছে। তার বয়স বারো-চোদ্দোর বেশি নয়। সে স্কুলে আসিয়া প্রথম দিনই সকলকে জানাইল, “আমি পোইট্রি লিখতে পারি!” এ কথা শুনিয়া ক্লাশসুদ্ধ সকলে অবাক হইয়া গেল; কেবল দু-একজন হিংসা করিয়া বলিল, “আমরাও ছেলেবেলায় ঢের ঢের কবিতা লিখেছি।” নূতন ছাত্রটি বোধ হয় ভাবিয়াছিল, সে কবিতা লিখিতে পারে, শুনিয়া ক্লাশে খুব হুলুস্থল পড়িয়া যাইবে, এবং কবিতার নমুনা শুনিবার জন্য সকলে হাঁ হাঁ করিয়া উঠিবে। যখন সেরূপ কিছুরই লক্ষণ দেখা গেল না, তখন বেচারা, যেন আপন মনে কি কথা বলিতেছে, এরূপভাবে, যাত্রার মত সুর করিয়া একটা কবিতা আওড়াইতে লাগিল
ওহে বিহঙ্গম তুমি কিসের আশায় 
বসিয়াছ উচ্চ ডালে সুন্দর বাসায়? 
নীল নভোমণ্ডলেতে উড়িয়া উড়িয়া 
কত সুখ পাও, আহা ঘুরিয়া ঘুরিয়া ! 
যদ্যপি থাকিত মম পুচ্ছ এবং ডানা 
উড়ে যেতাম তব সনে নাহি শুনে মানা—
কবিতা শেষ হইতে না হইতেই ভবেশ অদ্ভুত সুর করিয়া এবং মুখভঙ্গি করিয়া বলিল—
আহা যদি থাকত তোমার
ল্যাজের উপর ডানা উড়ে 
গেলেই আপদ যেত—
করত না কেউ মানা!
নূতন ছাত্র তাহাতে রাগিয়া বলিল, “দেখ বাপু, নিজেরা যা পার না, তা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেওয়া ভারি সহজ। শৃগাল ও দ্রাক্ষাফলের গল্প শোননি  বুঝি?” একজন ছেলে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো মুখ করিয়া বলিল, “শৃগাল অবং দ্রাক্ষাফল! সে আবার কি গল্প?” অমনি নূতন ছাত্রটি আবার সুর ধরিল
বৃক্ষ হতে দ্রাক্ষাফল ভক্ষণ করিতে 
লোভী শৃগাল প্রবেশিল দ্রাক্ষাক্ষেতে 
কিন্তু হায় দ্রাক্ষা যে অত্যন্ত উচ্চে থাকে 
শৃগাল নাগাল পাবে কিরূপে তাহাকে? 
বারম্বার চেষ্টায় হয়ে 
অকৃতকার্য ‘দ্রাক্ষা টক' বলিয়া পালাল ছেড়ে রাজ্য।
সেই হইতে আমাদের হরেরাম একেবারে তাহার চেলা হইয়া গেল। হরেরামের কাছে আমরা শুনিলাম যে ছোকরার নাম শ্যামলাল। সে নাকি এত কবিতা লিখিয়াছে যে একখানা দু'পয়সার খাতা প্রায় ভর্তি হইয়াছে, আর আট-দশটি কবিতা হইলেই তাহার একশোটা পুরা হয়, তখন সে নাকি বই ছাপাইবে।
ইহার মধ্যে একদিন এক কাণ্ড হইল। গোপাল বলে একটি ছেলে স্কুল ছাড়িয়া যাইবে, এই উপলক্ষে শ্যামলাল এক প্রকাণ্ড কবিতা লিখিয়া ফেলিল! তাহার মধ্যে ‘বিদায় বিদায়' বলিয়া অনেক ‘অশ্রুজল’ ‘দুঃখশোক’ ইত্যাদি কথা ছিল। গোপাল কবিতার আধখানা শুনিয়াই একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল, “হতভাগা, ফের আমার নামে পোইট্রি লিখবি তো এক থাপ্পড় মারব। কেন রে বাপু দুনিয়ায় কি কবিতা লিখবার আর কোনো জিনিস পাও নি?” হরেরাম বলিল, “আহা, বুঝলে না? তুমি ইস্কুল ছেড়ে যাচ্ছ কিনা, তাই ও লিখেছে।” গোপাল বলিল, “ছেড়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি, তোর তাতে কি রে? ফের জ্যাঠামি করবি তো তোর কবিতার খাতা ছিঁড়ে দেব।”
দেখিতে দেখিতে স্কুলময় রাষ্ট্র হয়ে পড়িল। তাহার দেখাদেখি আরও অনেকেই কবিতা লিখিতে শুরু করিল। ক্রমে কবিতা লেখার বাতিকটা ভয়ানক রকমের ছোঁয়াচে হইয়া নিচের ক্লাশে প্রায় অর্ধেক ছেলেকে পাইয়া বসিল। ছোট ছোট ছেলেদের পকেটে ছোট ছোট কবিতার খাতা দেখা দিল। বড়োদের মধ্যে কেহ কেহ শ্যামলালের চেয়ে ভালো কবিতা লিখিতে পারে বলিয়া শোনা যাইতে লাগিল। স্কুলের দেয়ালে, পড়ার কেতাবে, পরীক্ষার খাতায়, চারিদিকে কবিতা গজাইয়া উঠিল।
পাঁড়েজির বৃদ্ধ ছাগল যেদিন শিং নাড়িয়া দড়ি ছিঁড়িয়া স্কুলের উঠানে দাপাদাপি করিয়াছিল, আর শ্যামলালকে তাড়া করিয়া খানায় ফেলিয়াছিল, তাহার পরদিন ভারতবর্ষের বড়ো ম্যাপের উপর বড়ো-বড়ো অক্ষরে লেখা বাহির হইল
পাঁড়েজির ছাগলের একহাত দাড়ি, 
অপরূপ রূপ তার যাই বলিহারি! 
উঠানে দাপটি করি নেচেছিল কাল, 
তার পর কি হইল জানে শ্যামলাল।
শ্যামলালের রঙটি কালো, কিন্তু কবিতা পড়িয়া সে যথার্থই চটিয়া লাল হইল, এবং তখনই তাহার নীচে একটা কড়া জবাব লিখিতে লাগিল। সে সবেমাত্র লিখিয়াছে— ‘রে অধম কাপুরুষ, পাষণ্ড বর্বর!' – এমন সময় গুরু গম্ভীর গলা শোনা গেল – ”ম্যাপের ওপর কি লেখা হচ্ছে?” ফিরিয়া দেখে হেডমাস্টার মহাশয়! শ্যামলাল একেবারে থতমত খাইয়া বলিল, “আজ্ঞে স্যার, আগে ওরা লিখেছিল।” “ওরা কারা?” শ্যামলাল বোকার মত একবার আমাদের দিকে একবার কড়িকাঠের দিকে তাকাইতে লাগিল, কাহার নাম করিবে বুঝিতে পারিল না। মাস্টার মহাশয় আবার বলিলেন, “ওরা যদি পরের বাড়ি সিঁদ কাটতে যায়, তুমিও কাটবে?” যাহা হউক, সেদিন অল্পের উপর দিয়াই গেল, শ্যামলাল একটু ধমক-ধামক খাইয়াই খালাস পাইল।
ইহার মধ্যে একদিন আমাদের পণ্ডিত মহাশয় গল্প করিলেন যে, তাঁহার সঙ্গে যাহারা এক ক্লাশে পড়িত, তাহাদের মধ্যে একজন নাকি অতি সুন্দর কবিতা লিখিত। একবার ইনস্পেকটার স্কুল দেখিতে আসিয়া তাহার কবিতা শুনিয়া এমন খুশি হইয়াছিল যে, তাহাকে একটা সুন্দর ছবিওয়ালা বই উপহার দিয়াছিলেন।
ইহার মাসখানেক পরেই ইনস্পেকটার ইস্কুল দেখিতে আসিলেন। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটি ছেলে সাবধানে পকেটের মধ্যে লুকাইয়া কবিতার কাগজ আনিয়াছে। বড়ো হলের মধ্যে সমস্ত স্কুলর ছেলেদের দাঁড় করানো হইয়াছে, হেডমাস্টার মহাশয় ইনস্পেকটারকে লইয়া ঘরে ঢুকিতেছেন—এমন সময় শ্যামলাল আস্তে আস্তে পকেট হইতে একটি কাগজ বাহির করিল। আর কোথা যায়! পাছে, শ্যামলাল আগেই তাহার কবিতা পড়িয়া ফেলে, এই ভয়ে ছোট বড় একদল কবিতাওয়ালা একসঙ্গে নানাসুরে চিৎকার করিয়া যে যার কবিতা হাঁকিয়া উঠিল। মনে হইল, সমস্ত বাড়িটা কর্তালের মতো ঝন্ ঝন্ করিয়া বাজিয়া উঠিল- ইনস্পেকটার মহাশয় মাথা ঘুরিয়া মাঝপথেই মেঝের উপর বসিয়া পড়িলেন। ছাদের উপর একটা বেড়াল ঘুমাইতেছিল সেটা হঠাৎ হাত পা ছুঁড়িয়া তিনতলা হইতে পড়িয়া গেল, স্কুলের দারোয়ান হইতে অফিসের কেশিয়ার বাবু পর্যন্ত হাঁ হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল!
সকলে সুস্থ হইলে পর মাস্টার মহাশয় বলিলেন, “এত চেঁচালে কেন?” সকলে চুপ করিয়া রহিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হইল, “কে কে চেঁচাইয়াছিল?” পাঁচ-সাতটি ছেলে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল – ”শ্যামলাল।”
শ্যামলাল যে একা অত মারাত্মক রকম চেঁচাইতে পারে এ কথা কেহই বিশ্বাস করিল না। যতগুলি ছেলের পকেটে কবিতার খাতা পাওয়া গেল, স্কুলের পর তাহাদের দেড়ঘন্টা আটকাইয়া রাখা হইল!
অনেক তম্বিতাম্বার পর একে একে সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িল। তখন হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কবিতা লেখার রোগ হয়েছে? ও রোগের ওষুধ কি?” বৃদ্ধ পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “বিষস্য বিষমৌষধম্- বিষের ওষুধ বিষ বসন্তের ওষুধ যেমন বসন্তের টিকা, কবিতার ওষুধ তস্য টিকা। তোমরা যে যা কবিতা লিখেছ, তার টিকা করে দিচ্ছি। তোমরা একমাস প্রতিদিন পঞ্চাশবার করে এটা লিখে এনে স্কুলে আমায় দেখাবে।” এই বলে তিনি টিকা দিলেন—
পদে পদে মিল খুঁজে, গুনে দেখি চৌদ্দ 
এই দেখ লিখে দিনু কি ভীষণ পদ্য ! 
এক চোটে এইবারে উড়ে গেল সবি তা, 
কবিতার গুঁতো মেরে গিলে ফেলি কবিতা।
একমাস তিনি কবিদের কাছে এই লেখা প্রতিদিন পঞ্চাশবার আদায় না করিয়া ছাড়িলেন না। এ কবিতার কি আশ্চর্য গুণ তারপর হইতে কবিতা লেখার ফ্যাশান স্কুল হইতে একেবারেই উঠিয়া গেল।