ময়ূর ও ভগবান কৃষ্ণ

মাঠের পূর্বদিকে বহু দূরে গ্রামের কুঁড়েগুলি দেখা যায়। পশ্চিম দিকে প্রথমে হালকা গাছ গাছালি, ক্রমে বন গাঢ় ও ঘন।
বেলা দ্বিপ্রহর। রাখাল বালকেরা গরুগুলিকে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে এতক্ষণ খেলা করছিল। বালক নেতা শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং নিজে অত্যন্ত দুরন্ত। তার দুরন্তপনায় গ্রামে সবাই অস্থির হলেও, প্রচন্ড ভালোবাসে তাকে।
বলা বাহুল্য, রাখাল বালকদের নানা বিপদে আপদে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় শ্রীকৃষ্ণ। সাহস ছাড়াও তার অসংখ্য গুন। অপূর্ব তার ব্যবহার, মুখের কথায় যেন রত্ন ঝরে পড়ে।
আর সবচেয়ে বেশি আকর্ষনীয় – তার কোমরে গোঁজা বাঁশি। মোহন বাঁশি।
সকাল থেকে হই চইয়ের পর স্বাভাবিক ভাবেই ক্লান্ত বালকেরা গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়েছিল। তাদের অকুতোভয় নেতা শ্রীকৃষ্ণ সঙ্গে আছে, তারা কোনও বিপদের তোয়াক্কাই করে না।
আকাশে ইতিউতি মেঘ, বর্ষা এসে গেছে ধরিত্রীতে। ভোর রাতের দিকে জোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আবহাওয়া স্নিগ্ধ ও মনোরম। এখন রোদের তেমন তেজ নেই, আপাতত বৃষ্টিও নেই। বড় বৃক্ষের শীতল ছায়ায় রাখাল বালকেরা ঘুমিয়েই পড়েছিল একটু পরে।
ঘুমিয়ে পড়েছিল শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং।
ঘুমের মধ্যেই যেন কৃষ্ণ দেখতে পেল আকাশের ভাসমান মেঘ, মৃদুমন্দ বাতাস, বিকেলের শেষ সূর্যের সোনালী আভা।
ঘুম ভেঙে গেল শ্রীকৃষ্ণের।
কোমরে গোঁজা বাশিটি নিয়ে ফু দিল সে।
অমনি চরাচরে ছড়িয়ে পড়লো তার মোহন বাঁশির অপূর্ব মূর্চ্ছনা।
বালক কৃষ্ণ বাঁশিতে সুর তোলে অনায়াসে। আর সে সুর যে শোনে, সে তখন আর অন্য কিছু শোনে না। শুনতে পায় না।
এখনও তাই হলো। শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব সুরের মূর্চ্ছনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো জগত। বনের নিকটবর্তী যে সমস্ত প্রানী ছিল, তারা ভুলে গেল সন্ধ্যা আসন্ন, বাসায় ফিরতে হবে। রাখাল বালকেরা ঘুম ভেঙে মুগ্ধ হয়ে শুনছিল শ্রীকৃষ্ণের মোহন বাঁশি।
আর বনের অদূরে ছিল বেশ কিছু ময়ূর। কৃষ্ণের বাঁশির মূর্চ্ছনা তাদের দিল দোলা। পেখম তুলে নৃত্য শুরু করলো তারা। সুরের অভিঘাতে কয়েকটি ময়ূর যেন অজ্ঞান হয়ে পড়লো।
এর মধ্যে ময়ূরদের দলপতি এত বিভোর হয়ে পড়লো যে তার শরীর থেকে ক্রমেই খসে পড়তে শুরু করলো, অতি সুন্দর সপ্তরঙা পালক।
এক সময় বন্ধ হলো কৃষ্ণের বংশ বাদন।
বালক কৃষ্ণ তাকিয়ে দেখে, তার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ময়ূররাজ। তার সমস্ত পালক খসে পড়েছে। এবং সেগুলি নিয়ে সজল চক্ষে সে মিনতি করছে, প্রভূ, আমার এই পালকগুলি তুমি গ্রহণ করো। আমার আর দেওয়ার কিছু নেই। আমার শ্রেষ্ঠ ধন এই পালক, তোমায় দিলাম গুরুদক্ষিণা হিসেবে।
শ্রীকৃষ্ণ মুগ্ধ হয়ে গেলেন তার ভক্ত তথা ময়ূর রাজের এমন বিনয় ও ভক্তিতে। একটি পালক তিনি তুলে নিলেন নিজের মাথায়।
ভারী সুন্দর করে তা নিজের অবিন্যস্ত কেশের মাঝে গুঁজে নিলেন ময়ূরের পালক।
ততক্ষণাৎ যেন কোথাও বেজে উঠলো মঙ্গলশঙ্খ – শেষ সূর্যের সোনালি আভায় ভরে গেল দশ দিক।
শ্রীকৃষ্ণ ময়ূর রাজকে মধুর সম্বোধনে জানাল, বন্ধু, তোমার উপহার আমার মস্তকে ধারণ করলাম, কী অপূর্ব এই পালক। জগতের সমস্ত রঙের ছটা যেন ঠিকরে পড়ছে। তোমার এই পালক আমার সঙ্গে থাকবে চিরকাল, সবসময়।