ফুলের কথা

ফুল, পাখি ও আকাশের নক্ষত্র – প্রকৃতিতে এই তিনের কোনও তুলনা হয় না। বড় বা ছোট বৃক্ষের পাতার ফাঁকে নানা বর্ণের অপূর্ব সুগন্ধের ফুল বা গাছের ডালে অথবা আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া পাখি বা কুচকুচে কালো আকাশ জুড়ে অসংখ্য নক্ষত্র – আমাদের চরাচরে এই তিনে যেন স্বয়ং ঈশ্বর অবস্থান করেন।
এর মধ্যে ঈশ্বর তথা আমাদের আরাধ্য দেবতাদের নিয়ে যে অপরূপ পুরাণ কাহিনি, সেই কাহিনির সূত্রে আমরা পাই এক একজন দেবতার পুজোর জন্য বিশেষ বিশেষ ফুল।
ফুল মাত্রই সুন্দর। তার অসংখ্য ডিজাইন, প্রত্যেকটি ফুলের সুগন্ধ – কিন্তু একের সঙ্গে অন্যের মিল নেই। ফুলের পাঁপড়ির গড়নেও একের সঙ্গে অন্যের গুরুতর অমিল। আর এই ফুলকেই গাছ থেকে তুলে এনে আমরা সাজাই ফুলের সাঁজিতে।
ঈশ্বরকে পূজা নিবেদন করতে হলে ফুল যে চাইই – এর শুরু কবে থেকে – তার কোনও ইতিহাস নেই। তবে মানুষ সভ্য বলেই ফুলের সমঝদার হয়েছে। আরও একটু সভ্য হয়ে ফুলের মাঝে খুঁজে পেয়েছে ঈশ্বরকে। তাই তো ভগবানের কাছে আরাধনা করতে গেলে চাই ফুল।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আরাধ্য দেবতা অনেক। কিন্তু মহাদেব শিব ও তাঁর স্ত্রী পুত্র কন্যাদের নিয়েই আমারা নিত্য পুজো বেশি করি।
এছাড়াও রয়েছেন স্বয়ং ভগবান নিষ্ণু।
আমাদের, হিন্দু বাঙালিদের ছোট বেলার স্মৃতি যাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আবর্তিত হয়, তিনি বলা বাহুল্য শিব-পার্বর্তীর ছোট কন্যে সরস্বতী।
দেবী সরস্বতী ধরাধামে আসেন ইংরেজি বছরের শুরুতে এবং মনোরম শীত কালে। বা বাংলা বছরের প্রায় শেষ দিকে। প্রকৃতিতে সে সময় পলাশের আগুন। হিন্দু ধর্মের পুজোয়াচ্চা সবসময়ই প্রকৃতির বাস্তবতা মেনেই হয়। দেবী সরস্বতীর একক ভাবে আগমণের সময় প্রকৃতি ছেয়ে থাকে অনিন্দ্য সুন্দর পলাশে। তবে পলাশ ছাড়াও দেবীর পছন্দের রঙ সাদা। এমনও বিশ্বাস করা হয় যে, প্রতি শুক্রবার মায়ের কোনও বিগ্রহ বা ছবির সামনে পলাশ বা শ্বেত বর্ণের ফুল অর্পণ করলে পড়াশোনায় শুধু মন বসে তাই নয়, কর্মক্ষেত্রে মনঃসংযোগের উন্নতি হয়। যাদের পেশার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিদ্যা তথা সৃজন – তাদের জন্য প্রতি সপ্তাহে এই পূজা অত্যন্ত কার্যকরী ফল দেয়।
অর্থের দেবী মা লক্ষী স্বয়ং নিজের আসনটি নির্দিষ্ট করেছেন পদ্ম ফুলের উপরে। সুতরাং মা লক্ষীর প্রথম পছন্দ নিয়ে কোনও ভাবনার অবকাশ নেই। যে গৃহে মায়ের আসন পাতা থাকে, সেই গৃহের অর্থনীতি ভাল হয়। আর কে না জানে সংসার সুখে বাড়ে, যদি সেখানে মা লক্ষীর কৃপাদৃষ্টি বর্ষিত হয়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নতিতে যে বা যারা এগিয়ে থাকে, সমাজ সংসারে জয় হয় তাদেরই। মা দুর্গার হিমালয়ে ফিরে যাওয়ার দুদিন পর লক্ষী আসেন গৃহস্থের ঘরে। পনেরো দিন পর অমাবস্যাতেও বাঙালির ঘরে ঘরে লক্ষীর আরাধনা। প্রকৃতিতে তখন শীতলতার আমেজ। বর্ষা অতিক্রান্ত নদ ন্দী নালা পুকুর জলে টইটম্বুর। আর সেই নির্মল জলে প্রস্ফুটিত থাকে পদ্ম। হিন্দু শাস্ত্রের অনেক কিছুই প্রকৃতিকে মান্য করে বাস্তব সম্মত। সুতরাং পদ্ম ফুল বা পদ্ম বীজের মালা থাকে মা লক্ষীর চরণ ও কণ্ঠে।
মা লক্ষীর বিদায়ের পর আরও এক অত্যন্ত প্রিয় পুজো বাঙালির। মা কালী। কত শত সহস্র মানুষ মায়ের কাছে নিজের দুঃখ নিবেদন করে কত রকমের মানত কত্রে। আমরা পুজো দিই কিন্তু বিশেষ একটি ফুলে।
বলা বাহুল্য, করাল বদনা মা কালীর জিভের রঙের এই ফুল হলো জবা ফুল। জবা ফুলের মালা বিনে মা কালীর পুজো নৈব নৈব চ। এই রক্ত বর্নেরও অন্য অর্থ হয়। লাল তথা রক্ত বর্ণ শক্তির প্রতীক। মা কালীও শক্তির দেবী। বাঙালি মায়ের আরাধনাকে অনায়াসে বলে শক্তির আরাধনা।
সমুদ্র মন্থন হিন্দু পুরাণে অনেক কাহিনি উপহার দিয়েছে। তার একটি হলো, এই মন্থনের সময় জুঁই গাছের জন্ম। এত ছোট অথচ এত মনোহর এই ফুল যে দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং এই ফুলের বীজ হাত ছাড়া করতে চাননি। দেবরাজের আগ্রহেই জ্যঁই ফুলের বীজ আনা হয় স্বর্গে। এবং ইন্দ্র স্বয়ং স্বর্গের মাটিতে জুঁই ফুলের গাছ রোপণ করেন বলে পুয়ারাণ সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়। স্বর্গে যে ফুলের শিকড়, সেই ফুলের পুজো নেবেন কে?
কে আবার, স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু ছাড়া আর কে হতে পারে?
শ্বেত বর্ণের ছোট জুঁই ফুল দিয়ে মা লক্ষীর পুজোও করা হয়।
ভগবান বিষ্ণুর নিবেদনে যে ফুল দেওয়ার রীতি তা যেমন সমুদ্র মন্থনে উঠে এসছিল, দেবাদিদেব মহাদেব শিবের জন্য নির্দিষ্ট ফুলই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
মহাদেব শিব আমাদের প্রচলিত যে কোনও দেব দেবী বা আরাধ্য দেবতার থেকে একেবারে পৃথক। বাউন্ডুলে অথচ ঘোরতর সংসারী, নীলকণ্ঠ কিন্তু নেশা ভাঙের কোনও সীমা নেই, শ্মশানবাসী অথচ সমাজমুখী এমন বিস্ময়কর দেবতা মহাদেব। যাকে কোনো আকারে পরিমাপ করা যায় না। যার আদি বা অন্ত নেই।
সুতরাং তাঁকে নিবেদনের জন্য যে ফুল, তা অবশ্যই হতে হবে ব্যতিক্রমী।
পুরাণ গাথা অনুযায়ী, সেই ফুল উঠেছিল সমুদ্র মন্থনে। আর লৌকিক ভাবে আমরা জানি ধুতরো ফুল পাহাড় জঙ্গলের ফুল। সমতলে সাজানো বাগানে এই ফুলের সমাদর নেই। ধুতরো ফুল যেন মহাদেবের আচার আচরণ ও শক্তির সঙ্গেই মানানসই। পর্বতের অলিন্দে ধুতরো ফুলের বাহার। নীলকণ্ঠ দেবতার এই ফুলের বিষও মারাত্মক।