শাঁখা-নোয়ার বৃত্তান্ত

হিন্দু দেবদেবীই হোক বা কোনও সংস্কার – সব কিছুরই একটা পালন রীতি রয়েছে। মনে রাখা ভালো, হিন্দু ধর্ম তথা সনাতন ধর্ম কোনও ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা গড়ে ওঠেনি। ততকালীন অখন্ড ভারতবর্ষে এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে মানুষের যে সভ্যতা, তার বিবর্তনের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে হিন্দু ধর্ম। যে জন্য একই প্রসঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বহু মতের মিলনের ফলে পুষ্ট হয়েছে হিন্দু সভ্যতা।
যে কোনও হিন্দু আচারের পিছনে যেমন রয়েছে পৌরাণিক আলেখ্য, তেমনই এই আচারের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও রয়েছে বিভিন্ন সময়।
যেমন, বিবাহিত হিন্দু নারীর হাতে থাকে শাঁখা ও পলা। এই দুইএরই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যেমন আছে, তেমনই আছে পৌরাণিক আলেখ্য।
পৌরাণিক আলেখ্যটি বিখ্যাত পুরাণ গ্রন্থ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের।
পুরাকালে এক অসুরের নাম শঙ্খাসুর। ভয়ানক অত্যাচারী ও অসংযমী এই দৈত্যকে ভয় পেত সবাই। কিন্তু একবার এক যুদ্ধে সে নিহত হলো। তখন তার মৃত দেহ, শাস্তি স্বরূপ ভাসিয়ে দেওয়া হলো মহাসমুদ্রে।
অত্যাচারী এই অসুরের স্ত্রী তুলসীদেবী একেবারেই বিপরীত প্রকৃতির। স্বভাব শান্ত, ভগবান নিষ্ণুর অনুরাগী এবং পতিব্রতা। শঙ্খাসুরের কীর্তিকলাপ তার একেবারেই পছন্দ হতো না। কিন্তু স্বামীর অত্যচারে সে মুখ বুঁজে সব সহ্য করতো। কিন্তু শঙ্খাসুরের দেহ যখন সমুদ্রের নোনা জকে ভাসিয়ে দেওয়া হলো, তখন আর সহ্য হলো না তার।
তুলসী এবার কঠোর তপস্যা শুরু করে ভফবানের কাছ থেকে অমরত্বের বর প্রার্থনা করলেন।
ভগবান মৃত অসুরকে পুনরায় জীবিত না করেও তাকে এমন অসামান্য বর দিলেন যে, তুলসী ও তার স্বামী শঙ্খাসুর হিন্দু সংস্কারে অমর হয়ে রইলো।
ভগবান তার দেহ থেকে তুলসী গাছ এবং তার স্বামীর রক্ত বা অস্থি থেকে শঙ্খ বা শা%খার উতপত্তি করেন। এবং দুজনেরই ধর্মীয় কাজ নির্ধারণ করে দেন।
সেই থেকে সনাতন ধর্মীয় আচারে বিবাহিত নারীর তুলসী পূজা ও শাঁখা পলার ব্যবহারের চল শুরু হয়।
এ তো গেল পুরাণ কথা। কিন্তু হিব্দু নারীর যুগ যুগ ধরে শাঁখার ব্যবহারের নিশ্চয়ই কোনও না কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। সেই সূত্রে জানা যায়, খ্রীষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে শাঁখার প্রচলন শুরু হয়। আবার অন্য এক তথ্য মতে, দাক্ষিণাত্যে প্রায় দু’হাজার বছর আগে শঙ্খ শিল্প ছিল গরিমাময়। তামিলনাড়ুর প্রাচীন রাজধানী কোরকাই-এ ভগ্নস্তূপ আবিস্কৃত হয়। সেখানে শঙ্খ শিল্পের প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। তামিল সরকার এই আবিষ্কার সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
শঙ্খ কী? শঙ্খ আসলে এক জলজ প্রানী। শ্রীলঙ্কা ও চেন্নাইএর সমুদ্রতীরে শঙ্খের নমুনা পাওয়া যায়। শঙ্খের নানা রূপ, নানা জাতের জলজ প্রানী এটি। সাধারণত শ্রীলঙ্কা থেকে এখন শঙ্খ আমদানি করা হয়।
শঙ্খ শিল্প এক বিশাল ও অসামান্য শিল্প। তিতকৌড়ি শঙ্খকে সর্বোৎকৃষ্ট শঙ্খ ও আলাবিল নামক শঙ্খকে সর্ব নিম্ন শঙ্খ নলা হয়। (শঙ্খ নিয়ে আগামী অন্য লেখায় বিস্তৃত দেখুন)
হিন্দু বিবাহিত রমণী যেমন শাঁখা পরে, তেমনই পরে নোয়া। নোয়া আসলে লোহার তৈরি। সাধারণ ভাবে এই তথ্য স্বীকৃত যে, লোহাকেই অপভ্রংশে নোয়া করা হয়েছে। তবে আধ্যাত্মিক কারন ছাড়াও বৈজ্ঞানিক কারণ হিসেবে বলা হয়, রক্তের অন্যতম দুই উপাদান ক্যালসিয়াম ও আয়রণ। নারীর রজঃস্রাবের সময় এই দুই পদার্থ তার শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। সে ঘাটতি পূরণ হয় শাঁখা ও নোয়ার স্পর্শে।
আধ্যাত্মিক কারণে বলা হয়, শাঁখার রঙ সাদা, সিঁদুরের লাল এবং লোহার রঙ কালো। যথাক্রমে সত্বগুণ, রজঃগুণ এবং তমোগুণের প্রতীক এই তিন রঙ। সংসারের শুভ কামনায় নারীকে অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। তার সত্বগুণ তাকে সাত্বিক করে তোলে, রজঃগুণ ও তমোগুণ তথা কামনা বাসনা ঈর্ষা কাতরতা জয় করে সে সংসার ধর্মে নিজেকে স্থিত করে।
সংসার সুখে হয় রমণির গুনে – এই আপ্তবাক্য গ্রাম বাংলায় চিরকালীন।