দেবরাজ ইন্দ্র সুদর্শন, বলবান, বুদ্ধিমান তো অবশ্যই। অথচ সারাদিনের কাজ ও অপ্সরাদের সঙ্গ থাকার সময়েও গুপ্তচরের কাছ থেকে অবিরাম তথ্য সংগ্রহ করে যান – কে কোথায় তপস্যা করে অমরত্ব বা দেব লোকের সর্বনাশের বর চাইছে। এমন অনেক বার হয়েছে, কোনও অসুর বা নর অথবা স্বর্গেরই কোনও সাধারণ দেবতা সত্যিই দেবাদিদেব শিব বা ভগবান শ্রীবিষ্ণুর কাছ থেকে অমরত্বের বর প্রাপ্ত করে প্রথমেই ইন্দ্রের সিংহাসনের দিকে নজর দিয়েছে।
তবে যাইই ঘটুক না কেন, দু এক বার বিপদে পড়লেও শেষ পর্যন্ত সামলে নিয়েছেন দেবরাজ। তাঁর আসন টলোমলো হতে হতেও রক্ষা পেয়েছে ভগবানেরই আশীর্বাদে।
এবার সত্যিই এক বিভ্রমে পড়লেন দেবরাজ ইন্দ্র। কারণ চর যে সংবাদ এনেছে, তেমন বিভ্রান্তিকর সংবাদ অন্তত তিনি কখনো শুনেছেন বলে তাঁর মনে পড়ল না।
কী সংবাদ?
দেব ঋষি নারদের খোঁজ পাওয়া গেছে !!!!
দেব ঋষি, অবিরাম সারাক্ষণ মুখে শ্রীবিষ্ণুর স্মরণ করেন যে মানুষ, তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই উধাও। কেউ জানেন না কোথায় দেব ঋষি নারদ।
দেব ঋষি নারদের একটা মুদ্রাদোষ আছে বটে, এদিকের খবর কোনও কিছু না ভেবে ওদিকে বলে ফেলেন, কিন্তু ইন্দ্র জানেন, মানুষটি তার শুভাকাঙ্ক্ষী।
এ হেন মানুষ সমস্তক্ষণ ব্রহ্মান্ড চষে বেড়ান। ফলে তাকে সর্বক্ষণ স্বর্গে দেখাও যায় না। তবে খুব বেশিদিন স্বর্গের আলো বাতাস অপ্সরীদের দর্শন ছাড়া কোনও দেবতাই বাইরে থাকেন না। দেব ঋষি নারদও নন। সেই নারদ একটা দীর্ঘ সময় ধরেই নিরুদ্দেশ।
চর তাঁর খোঁজ এনেছে।
কিন্তু সংবাদটি শুনে দেবরাজের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। একটু অস্বস্তিও হলো তার মনে।
সংবাদে জানা গেল, হিমালয়ের পাদদেশের কাছে অত্যন্ত সুন্দর এক প্রাকৃতিক পরিবেশকে আরো মনোরম করে বয়ে চলেছে গঙ্গা। সেই নদীর অদূরে সুন্দর গভীর বনানী। বড় বড় বৃক্ষ রাজি, লতা গুল্ম।
আর সেখানেই রয়েছে এক বিশাল রহস্যময় গুহা।
দেব ঋষি সেই অতি শান্ত, নির্জন গুহায় গভীর তপস্যায় লীন হয়ে রয়েছেন বেশ কিছুদিন। যে কোনও তপস্যাই বেশ ক্লেশদায়ক। বিশেষ করে কঠিন, বড় সড় প্রাপ্তির আশা করে যারা তপস্যা শুরু করেন, তারা জানেন, এ এক কঠোর কঠিন পথ। সহজে প্রাপ্তি হয় না। শিব পার্বতী বা বিষ্ণু ভগবানকে অত সহজে সন্তুষ্ট করা যায় না।
দেব রাজ ইন্দ্র জানেন, দেব ঋষি নারদ সতত ভগবান শ্রীবিষ্ণুর নাম করেন। ওই নাম উচ্চারণেই তিনি ভগবানের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে থাকেন। কঠোর তপস্যায় দেব ঋষিকে কখনো করতে হয় নি। তার প্রয়োজন পড়ে নি যে। তিনি তো অল্পেই সন্তুষ্ট।
তাহলে ঋষির এ হেন তপস্যার কী প্রয়োজন? কেন শরীরকে এমন ক্লেশ দিচ্ছেন দেব ঋষি? কেন এমন একটি নির্জন গুহা নির্বাচন করলেন তিনি? এত গোপনীয়তার কারণ কি? নিশ্চয়ই বড় কোনও প্রার্থনা আছে তাঁর?
দেব-সিংহাসনের থেকে বড় আর কিছু আছে বলে জানেন না দেবরাজ ইন্দ্র। সুতরাং এবার দুশ্চিন্তা এমনই গ্রাস করলো তাকে যে অপ্সরাদের নৃত্য ও সঙ্গীত মুহুর্তে বিস্বাদ ঠেকলো তার। ইন্দ্রের মাথায় পোকার মতো ঘুরতে লাগল একটি কথা। তা হলো, ঋষি এবার রাজা হতে চাইছেন। দেব ঋষির মন এবার রাজার সিংহাসনে। সেটা ভাল না খারাপ, সে কথা পরে। তবে হঠাত এমন কঠোর তপস্যার আর কী কারণ হতে পারে?
দু একদিনের মধ্যে অস্থির হয়ে পড়লেন দেবরাজ ইন্দ্র। খবর পাঠালেন অতি ঘনিষ্ঠ বান্ধব কামদেবকে।
কামদেব মদনদেব। চির যৌবনের দূত। অসুর দেবতা মানব তো কোন ছাড়, তাঁর কাম বাণে স্বর্গ-নরকের যে কাউকে ধরাশায়ী করে ফেলতে পারেন। একবার দেবাদিদেবের ক্রোধে ভস্ম হয়ে প্রাণটা খুইয়ে ছিলেন ঠিকই, তবে ঋষি, দেবতা, অসুর বা মানবের তপস্যা ভঙ্গ তিনি যে কত সহস্রবার করেছেন, তার কোনও ঠিক নেই।
ইন্দ্রের আদেশ এলো বন্ধুবর মদনদেবের কাছে। গোপন গুহায় তপস্যায় লীন হয়ে রয়েছেন, একেবারে নির্বাক ও স্তব্ধ হয়ে রয়েছেন সদা বিচরণশীল নারদ। নারদের আরো একটি খ্যাতি বা অখ্যাতি রয়েছে। তিনি প্রচুর কথা বলেন।
সেই নারদের মুখে কথা নেই। তিনি গভীর তপস্যামগ্ন।
সুতরাং দেবরাজ ইন্দ্র প্রায় আদেশই করলেন, হে মদনদেব। তুমি যাও ওই অরণ্যে। ওই গুহায় নারদমুনি লোভের বশবর্তী হয়ে তপস্যা করছেন। ওঁকে কাম বাণে এমন বিধ্বস্ত করো যে, তপস্যা ভঙ্গ করে দেব ঋষি যেন পলায়ন করেন।
মদনদেব, তাঁর সেরা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যখনই হিমালয়ের কোলে ওই নির্জন বনানীতে গিয়ে পৌঁছলেন, তখনই ভোল বদলে গেল প্রকৃতির। শুধুই নির্জন সৌন্দর্য নয়, কোকিলের কুহু তানে, হরিণীর চঞ্চল চলনে, বাতাসে আঘ্রাণে ফুলের অপূর্ব গন্ধে প্রকৃতি তার শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য যেন উপুর হস্ত করে দিলেন।
দেব ঋষি নারদ তপস্যার মধ্যেও টের পেলেন এই প্রাকৃতিক পরিবর্তন।
কারণ আর কিছুই নয়। দেব ঋষি ঠিক কোনও কিছু লাভের আশায় ধ্যান করছিলেন না। ব্রহ্মান্ড ঘুরতে ঘুরতে আচমকা এই বনানীর কাছে প্রবাহিত গঙ্গাকে দেখে মোহিত হয়ে পড়েন নারদ মুনি। কোনও লোভ নয়, তাঁর মনে চির জাগরুক ভগবান শ্রী বিষ্ণু। তিনি মোহিত হওয়ার মুহুর্তেও ভগবানের নাম নিতে নিতে সহসা ঠিক করেন, তপস্যায় বসে ভগবানের নাম আরো গভীর ভাবে করবেন। অনেক দিন ধ্যানে ঠাকুরের নাম করা হয় নি।
পাহাড়ে জলস্রোত অবিরাম কল কল ধারায় প্রবাহিত হয়। তার কলতানে মুগ্ধ হয়ে প্রবাহিত গঙ্গার সামান্য অদূরে একটি অনুপম গুহা নজরে পড়লো তাঁর। আর কালবিলম্ব না করে তিনি ভগবানের তপস্যায় নিজেকে সমর্পন করেন।
তাঁর তো সেভাবে কোনও পিছুটান নেই। প্রায়শই কিছুটা ভবঘুরের মতোই নারদ মুনি ঘুরে বেড়ান স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল। সর্বত্র তাঁর অবাধ গতি। যখন যেখানে খুশি যেতে পারেন, থেকে যেতে পারেন।
তাঁর জন্য বাড়িতে কেউ পথ চেয়ে নেই। মাত্র কিছুদিন তাঁর অদর্শনে যে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র এমন অস্থির হয়ে পড়বেন, তা আর তিনি বুঝবেন কী করে?
প্রকৃতির পরিবর্তন টের পেলেও নারদ মুনি তখনো সম্যক জানেন না, ঠিক কী হতে চলেছে তাঁর চতুস্পার্শে।
ভগবান শ্রী বিষ্ণুর নাম নিতে নিতে কিঞ্চিত চঞ্চল ও কৌতূহলী হয়ে উঠলেন তিনি। ধুরন্ধর ও কামদেব কিন্তু বুঝলেন, তাঁর আগমনে ঋষির মনে চাঞ্চল্য এসেছে। মনে মনে তিনি হাসলেন। কত অজেয় বীর তাঁর কাম বানে বিধ্বস্ত হয়ে দিগভ্রান্ত হয়েছে তার ইয়ত্বা নেই। এ তো সামান্য সাধু পুরুষ।
মদনদেব একটি কাম বান নিক্ষেপ করলেন। তিনি তখন মোটামুটি নিশ্চিত যে, যুদ্ধটি এক তরফা হতে চলেছে। স্রেফ তাঁর আগমনেই যাঁর চিত্ত নৃত্য করে, কাম বানে সে ভেসে যেতে বাধ্য।
নারদ মুনি শরীরে সামান্য অস্বস্তি বোধ করে চক্ষু উন্মীলিত করলেন। এবং মুহুর্তে পুরো বিষয়টি তাঁর বোধগম্য হলো। কাম দেব তাঁর বানে তাঁকে ‘শিকার’ করতে এসেছেন, বুঝলেন তিনি। সামান্য সময় তপস্যা স্থলে বসে থাকার পর আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লেন নারদ মুনি।
তাঁর মুখ চোখে তপস্যার কোনও ক্লেশ নেই। ক্লান্তি নেই শরীরের ভাষায়। বরং বিরক্তিতে মুখমন্ডলে একটা গম্ভীর ভাব। সামনেই পেয়ে গেলেন দিব্যকান্তি মদনদেবকে।
মদনদেব বরং এবার বিচলিত হলেন।
কী কান্ড! ঋষি ঠাকুর তো কাম বান হেলায় জয় করে ফেলেছেন। শরীরের ভাষায়, মুখ চোখের ইঙ্গিতে কোথাও কামের কাতরতা নেই। তিনি সহজ ভাবে নিয়েছিলেন বলে আফশোষ করতে শুরু করলেন মনে মনে।
আর ঠিক তখুনি যেন, দেব ঋষি তাঁর মনের কথাটি পড়ে ফেললেন। বিরক্ত হয়ে নারদ মুনি বললেন, কী ব্যাপার কাম দেব? এমন বেয়াদপির কারণ কী? আমার ধ্যান ভঙ্গ করতে কে পাঠালো আপনাকে? আর কেনই বা পাঠালো?
মদনদেব সেই মুহুর্তে যুদ্ধে হেরে নতমুখ। তিনি আশংকাই করেন নি যে এমনটা হতে পারে। তাঁর কাম বান হেলায় অগ্রাহ্য করতে পারেন, এমন মহারাজ জগতে আছেন? আশ্চর্য হলেন মদনদেব।
কোনও চালাকি না করে মদনদেব হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিলেন দেবঋষির কাছে। বললেন, ক্ষমা করুন দেবর্ষি। আমি আপনাকে আর এক মুহুর্তও বিরক্ত করবো না।
কামদেবের মারাত্মক ছোবল হেলায় জয় করে নিয়েছেন ভেবে নারদ মুনি তখন এমনই পুলকিত যে, কে পাঠিয়েছিলেন মদনদেবকে, তার উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। বরং একটা নাতিদীর্ঘ তপস্যা ভঙ্গের পর আসন থেকে গাত্রত্থান করলেন। শ্রীবিষ্ণুর নাম স্মরণ করতে করতে খাদ্যের সন্ধানে বনভূমিতে এলেন। চকিতে তাঁর মনে হলো, এত বড় একটা কান্ড তিনি ঘটিয়ে ফেলেছেন – এটা তো অবিলম্বে দেবাদিদেব মহাদেব শিব ও ভগবান বিষ্ণুকে জানানো দরকার।
তিনি কোনও কিছু প্রাপ্তির আশায় ধ্যানে বসেননি। শুধুই ভগবানের নাম একটু নিভৃতে নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, তাই নির্জন স্থান নির্বাচন।
দেবঋষির সেই মুহুর্তে কিঞ্চিৎ অহংকার হলো। সাধারণত সবাই জানে যে মানুষটা একেবারেই নিরহংকারি। শুধুমাত্র ভগবান বিষ্ণুর নাম করা ছাড়া তাঁর কোনও অভিলাষের কথা কেউ কোনও দিন শোনেনি। তিনি নিজেও কখনও কোনও কিছুর প্রপ্তির আশা করেন নি।
মনের কোণে অহংকারের ভাবনা থেকেই নারদ মুনি সটান চলে গেলেন দেবাদিদেব শিবের কাছে। মহাদেবও একসময় মদনদেবের কামবাণে কাহিল হয়েছেন। কাহিল হয়েছেন স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। দেব ঋষি নারদ সবিস্তারে সব বর্নণা করলেন শিবের কাছে। কাম জয় করতে পেরেছেন বলে তাঁর মনে যে অহংকার জন্মেছে, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারলেন দেবাদিদেব শিব। মহাদেব শিব একটু সতর্ক হয়েই নারদ মুনিকে বলেন, হে মুনি, আপনি মানসিক ভাবে অত্যন্ত শক্তিমান। তবে আমাকে যেমন সব কাহিনিটি শোনালেন, ভগবান বিষ্ণুর কাছে সেটা না করলেই ভাল।
সেই মুহুর্তে নারদ মুনির মনে ডাল পালা মেলছে অহংকার। তীব্র অহংকার। যে কাম বাণ মহাদেব শিব জয় করতে পারেন নি, পারেন নি ভগবান বিষ্ণু জয় করতে, তিনি হেলায় তা কব্জা করেছেন। কখনও এক চিলতে অহংকার তার মনে বাসা বাধেনি। অথচ এখন সেটাই হলো।
শিবের কথা না শুনে দেবঋষি চলে গেলেন বিষ্ণুর কাছে।
সব কথা সবিস্তারে আবার বললেন নারদ।
ভগবান সহজেই নারদ মুনির মনের অবস্থা বুঝে গেলেন। তাঁর একটু দুঃখই হলো। তাঁর এমন একনিষ্ঠ ভক্ত শুধু তার দর্শন করে তৃপ্ত হয়, সে-ই কীনা এমন অহংকারি হয়ে উঠলো? বিষ্ণু মনে মনে বললেন, এই অহংকার তার ভক্তের ক্ষতি করবে। সুতরাং কিছু একটা বন্দোবস্ত করতেই হয়।
ভগবানের মনের কথা বুঝতে পারলেন না দেব ঋষি নারদ। পরম তৃপ্তি তাঁর চোখে মুখে তখন। সোজাসুজি বলা যায় না, তাই তিনি বলেন নি। কিন্তু আভাসে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন এই কথাটি যে, স্বয়ং ভগবান যে কাম বান জয় করতে পারেন নি, মহাদেব শিব যে বাণে কাবু হয়েছেন, তিনি দেব ঋষি নারদ তা হেলায় জয় করেছেন।
নারদ ভগবান বিষ্ণুর ডেরা ছেড়ে বেরিয়ে দেব লোকের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
অকস্মাৎ দেখেন পথের অদূরে এক ভারী সুন্দর নগরী। অহংকার তখন তাঁর শিরায় শিরায়। ফলে নারদ মুনি বুঝতেই পারলেন না, ভগবান বিষ্ণু তাঁকে একটি শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই নকল নগরী নির্মাণ করে তাঁকে প্রলুদ্ধ করছেন।
কে এই নগরীর রাজা, জানতে নারদ মুনি ঢুকে পড়লেন নগরীর ভিতরে। নগরীর বৈভব দেখে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। জানা গেল রাজার নাম শীলনিধি।
রাজা মশাই স্বয়ং এসে অভ্যর্থনা জানালেন দেব ঋষিকে। এবং সাদরে রাজপ্রাসাদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে রাজকন্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আসলে নারদ মুনি জ্যোতিষ চর্চাও করেন। রাজা মশাই তাই চাইলেন, মুনি যেন তাঁর কন্যার হস্তরেখাটির যথার্থ বিচার করে দেন।
মদন দেবের কাম বাণ তাঁকে ধরাশায়ী করতে পারেনি বলে ইতিমধ্যেই প্রবল এক অহংকার চেপে বসেছে দেব ঋষির মনে। তিনি অহং বোধে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো আক্কেলজ্ঞান হারিয়েছেন তখন।
রাজা শীলনিধির কন্যা বিশ্বমোহিনীর রূপ দেখে হতবাক হয়ে গেলেন মুনিবর। তাঁর মনের অভ্যন্তরে জেগে উঠতে শুরু করলো এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। বিশ্বমোহিনীর হস্ত রেখা দেখে আরো একবার চমকিত হলেন নারদ মুনি। কারণ মেয়েটির হস্তরেখায় রয়েছে তার ভাবী স্বামীর অমরত্বের ইঙ্গিত। অর্থাৎ, যে এই কন্যাকে বিবাহ করবে, সে হয়ে উঠবে অমর। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল তার পদতলে থাকবে।
নারদ মুনির মাথা ঘুরে গেল। ভগবান বিষ্ণু তখন তাঁর অতি প্রিয় পাত্রের এমত দশায় একই সঙ্গে সুখী ও দুঃখিত। সুখী, কারণ অহংকারী মানুষটির অহংকার এবার বিনষ্ট হবে।
আর দুঃখিত এই জন্য যে, তিনি জানেন এই মানুষটি তাঁর সবচেয়ে বড় ভক্ত এবং মানুষটি সত্যই ভাল।
কোনও ভাল মানুষের যখন পদস্খলন হয়, তখন তার চেয়ে দুঃখের কিছু হয় না। ভগবান বিষ্ণু কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত যেন সসম্মানে এই ‘কাম-ঘোর’ থেকে মুক্ত হতে পারে। মদন দেবের কাম বান তাকে স্পর্শ করতে পারেনি বলে নারদের অহংকার হয়েছিল। কিন্তু মায়াবী রাজকন্যে বিশ্বমোহিনী তাঁকে কামাতুর করে তুলল, দেব ঋষি নারদ তা বুঝেও বুঝলেন না। বরং তাঁর মনের তন্ত্রীতে ঝড় তুলল বিশ্বমোহিনীর অপূর্ব দেহসৈষ্ঠব। অসামান্য মুখশ্রী।
নারদ ঠিক করে ফেললেন, তিনি সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হবেন।
কিন্তু ঠিক করলেই তো হবে না। রাজা শীলানিধি তার কন্যার জন্য স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেছেন, কানে গেছে দেব ঋষির। তবে মেয়েটি তাঁকে পছন্দ করবে তো? স্বয়ংবর সভায় অল্প বয়সী সুদর্শন বীরপুরষদের রূপে তো পরাস্ত করতে হবে।
মরিয়া হয়ে ভগবান বিষ্ণুর স্তব করতে শুরু করলেন নারদ মুনি।
ভগবান মনে মনে হাসলেন, এবং সময় নষ্ট না করে প্রকট হলেন তাঁর প্রিয় ভক্তের সুমুখে।
ভগবান বিষ্ণুর মতো সুদর্শন, এমন লাবণ্যময়, এমন সুপুরুষ ত্রিলোকে দেখেননি নারদ মুনি। সুতরাং সোজা কথা সোজাই বলে ফেললেন ভগবানের কাছে। বললেন, বিশ্বমোহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার বরমাল্য পাওয়ার জন্য ভগবান যেন তাঁর ঐশ্বরিক রূপটি ভক্তকে উপহার দেন। সেক্ষেত্রে বিশ্বমোহিনীকে জয় করা নিয়ে তার আর কোনও সংশয়ই থাকবে না।
মনে মনে হাস্য করলেন ভগবান বিষ্ণু। একই সঙ্গে তার মনে কিঞ্চিৎ অনুতাপও হলো। কারণ তার অতিপ্রিয় ভক্তের আদরে তিনি সজ্ঞানে একটি অন্যায় কাজ করতে চলেছেন।
ভগবান বিষ্ণু নারদ মুনির মুখশ্রী মায়াবলে পালটে দিলেন। চেহারাও হয়ে গেল তরুণ। দেবাদিদেব শিবের দুই শাকরেদ সে সময় ওই পথে পরিভ্রমণ করছিল। তারা ভগবান বিষ্ণুর কাণ্ডকারখানা দেখছিল। তারা বুঝেছিল, মায়ার এই খেলায় ভগবানের কোনও সদিচ্ছা আছে। তারাও রূপ বদল করে দুই ব্রাহ্মণ সেজে নারদের সঙ্গে পরিচয় করতে চলে এলো।
দেব ঋষি ইতিমধ্যে ভুলে গেছেন, তাঁর এতদিনের সাধ ও সাধনা। রাজকুমারি বিশ্বমোহিনীর পানি গ্রহণের জন্য তিনি হাজির হলেন স্বয়ংবর সভায়। দুই ছদ্মবেশি ব্রাহ্মণ নারদকে এই বলে তাতাতে লাগল যে, এমন রূপবান পুরুষকেই বরমাল্য দেবে বিশ্বমোহিনী।
স্বয়ংবর শুরু হলো। কিন্তু বিশ্বমোহিমী ফিরেও তাকালো না আপাদমস্তক বদলে যাওয়া নারদের দিকে। ভগবান বিষ্ণু ছদ্মবেশে এসে তার মালা প্রাপ্ত করলেন।
নারদ অত্যন্ত হতাশ হয়ে জোরে জোরেই বলে ফেললেন, কন্যের বুদ্ধিনাশ হয়েছে। না হলে আমার মতো রূপবান মানুষকে ছেড়ে কে এক পুরুষের গলায় বরমাল্য দেয়।
শিবের দুই শাকরেদ ব্রাহ্মণ সেজে এতক্ষণ ঘুর ঘুর করছিল নারদ মুনির পাশে পাশেই। এতক্ষণ তারা দেব ঋষিকে রূপবান বলে তাতাচ্ছিল। এবার তারা মুনিবরকে বলল, আপনার মতো এমন কুরূপ পুরুষকে কে বরমাল্য দেবে?
নিজের কুরূপ শুনে বেদম ঘাবড়ে গিয়ে নারদ মুনি তৎক্ষণাৎ জলের ভিতরে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে গেলেন।
এবং দেখা মাত্র তাঁর হয়ে গেল আক্কেলগুড়ুম।
জলের ভিতরে নিজেকে দেখতে পেলেন না নারদ, রূপবান পুরুষ তো দূর। দেখলেন একটি বানর তার দিকে তাকিয়ে। অর্থাৎ তাঁর মুখশ্রী বানরের মতো হয়ে গেছে ভগবানের কৃপায়।
দুই ছদ্মবেশি ব্রাহ্মণ হাস্য করে বলল, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।
একেবারে ক্রুদ্ধ হয়ে নারদ মুনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। দুই ছদ্মবেশি ব্রাহ্মণকে অভিশাপ দিলেন, তোরা রাক্ষস হয়ে জন্মগ্রহণ করবি।
তারা করজোরে দেবঋষিকে প্রনাম করে অদৃশ্য হয়ে গেল। বিস্মিত নারদ মুনি বুঝলেন, কোথাও কোনও প্রমাদ ঘটেছে। তিনি আবার জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখলেন এবং চমকিত হলেন।
কোথায় বানর? ওই তো আদি অকৃত্রিম নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন। ত্রিলোক যে রূপে তাঁকে দেখে, ওই তো তিনি।
এইবার ভয়ংকর ক্রুদ্ধ ও অভিমানী হয়ে ভগবান বিষ্ণুর খোঁজে চললেন নারদ।
বেশিদূর যেতে হলো না তাকে। কারণ এখনো উচিত শিক্ষাটি দেওয়া হয় নি বলে ভগবান বিষ্ণু বিশ্বমোহিনীকে নিয়ে নিকটেই অপেক্ষা করছিলেন।
আবার সামনে বিশ্বমোহিনী !
হতবাক হয়ে গেলেন নারদ। তা-ও আবার তাঁরই আরাধ্য ভগবানের সঙ্গে !
দুইএ দুইএ চার করে ফেললেন নারদ মুনি। তার মানে তাঁকে বানর সাজিয়ে, ঠকিয়ে, ভগবান স্বয়ং বিশ্বমোহিনীকে বিবাহ করতে চলেছেন !
ক্রুদ্ধ দেব ঋষি যার নাম গান করেন সারাক্ষণ, এবার চৈতন্য হারালেন। প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে ভগবানকেই অভিশাপ দিয়ে বসলেন এবার। বললেন, আমি ভগবান নই, নেহাতই ঋষি। আমি আপনার মতো মনের কথা পড়তে পারি না। তাই বুঝতে পারিনি, আপনার মনে কামের উদয় হয়েছে। বিশ্বমোহিনীকে প্রাপ্ত করতে চাইছেন আপনি, এ কথা আমার বোধগম্য হলে, আমি কোনও বর চাইতাম না। আমাকে ঠকানোর জন্য আপনার একটি শাস্তি প্রাপ্য। সুতরাং আমি আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি আপনাকে মর্ত্যে মনুষ্য রূপে জন্মাতে হবে। আমাকে যেমন আপনি কপটতা করে স্ত্রী ভাগ্যে নেতি করলেন, মর্ত্যে আপনারও স্ত্রী ভাগ্যে নেতি হবে। আর আমার মুখশ্রী বানর করেছেন, আমাকে উপহাস করেছেন অন্যদের সুমুখে, ওই বানররাই আপনার বিপদে আপনার পাশে দাঁড়াবে, ওদের সাহায্য নিতে বাধ্য হবেন আপনি, এটাই হবে আপনার মনুষ্য জীবনের দায়।
শান্ত ভাবে প্রিয় ভক্ত নারদের অভিশাপ আত্মস্থ করলেন ভগবান বিষ্ণু। তারপর স্মিত হাস্যে বললেন, নারদ, তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। তোমার সঙ্গে আমি কোনও কপটতা করিনি। তবে তুমি জানো না, তোমার মনে কিঞ্চিৎ অহং-এর উদয় হয়েছিল। সেটা তোমার মতো মহান মানুষের মানায় না। ওই অহং নাশ করার জন্য আমাকে কিছু কৌশল করতে হয়েছে। তাতে তুমি মানসিক আঘাত পেয়েছো। ফলে ওইটে তো অন্যায়ই হয়েছে আমার দিক থেকে। কিন্তু বৎস, এ ছাড়া আমার যে কোনও উপায়ও ছিল না। তবে তোমার অভিশাপ আমি মাথা পেতে নিলাম।
ভগবান এ কথা বলতে বলতে দেব ঋষির সামনে থেকে মায়াজাল সরিয়ে নিলেন।
চোখের নিমেষে বিশ্বমোহিনী ও শীলানিধির কৃত্রিম নগর অদৃশ্য হয়ে গেল।
তখন মুখোমুখি ভক্ত ও তার আরাধ্য ঈশ্বর – যথাক্রমে নারদ ও ভগবান বিষ্ণু।
হতচকিত হলেন নারদ। বিস্ময়ে তার চোখ মুখের চেহারা বদলে গেল। এবং মুহুর্তে বোধগম্য হলো, ভয়ানক এক ভুল তিনি করে ফেলেছেন।
নারদের ধাতস্থ হওয়া লক্ষ্য করছিলেন বিষ্ণু ভগবান। নারদের মন থেকে প্রবল ঝঞ্জায় যেমন বৃক্ষের পত্র উড়ে যায়, তেমন ভাবেই বিলীন হয়েছে অহংকার – টের পেলেন ভগবান। মৃদু হাস্যে বললেন, তুমি বলেছিলে, তুমি মদন দেবের কাম বান জয় করেছো। তোমার অহংকার তোমার চরিত্রের পরিপন্থী – নারদ, ত্রিলোকের সবাই তোমায় ভালবাসে। সর্বত্র তোমার অবারিত দ্বার, কেন জানো? তুমি নিরহঙ্কারী, তাই। আমি তাই মায়াজালে তোমায় প্রলুদ্ধ করেছিলাম।
নারদের দু চোখ ভরে গেল অশ্রুতে। তিনি করজোর করে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। বারংবার বলতে লাগলেন, আমি অধম। আমার কোনও যোগ্যতা নেই প্রভূ আপনার নাম গান করার। আমি আপনাকে অভিশাপ দিয়ে বসেছি – ছি ছি ছি –
ভগবান বিষ্ণু তার প্রিয়তম ভক্তকে শান্ত করলেন অতি কষ্টে। বললেন, দেব ঋষি, ব্রহ্মান্ডে যা কিছু হয় সব আমার ইচ্ছাতেই হয়।
নারদের অভিশাপ পূর্ণ করতে মর্ত্যে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ভগবান বিষ্ণু। তার স্ত্রী রত্ন দূরে সরে গিয়েছিল। তাঁকে বিপদের দিনে বানরদের সাহায্য নিতে হয়েছিল। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ভক্তই তো হনুমান। আর সেই দুই দেবাদিদেবের শাকরেদ রাক্ষস হিসেবে জন্ম নিয়েছিল।
তাদের মুক্তি ঘটেছিল মনুষ্যবেশী ভগবান বিষ্ণুর হাতেই।
তারা দুজন হলেন লঙ্কারাজ রাবন ও কুম্ভকর্ণ।
বলাবাহুল্য ভগবান বিষ্ণু মর্ত্যে এসেছিলেন রামচন্দ্র রূপে। তার স্ত্রী সীতা। শ্রেষ্ঠ ভক্ত পবন পুত্র হনুমান। রাজা সুগ্রীবের বানর সেনা তার সহায় ছিল লঙ্কা যুদ্ধে।