রূপবান, ব্যক্তিত্ববান। কিন্তু সুঠাম চেহারার যুবকটির চোখেমুখে যেন কিছুটা অবসাদ। বিষণ্ণতা।
অতি শীতল এক বাতাস বইছে। ক্রমশ আলো ফুটছে চতুস্পার্শে, ভোর হচ্ছে। অন্ধকারে অবিন্যস্ত জঙ্গল ও গাছগাছালির মধ্যে ইতি উতি পড়ে আছে বড় বড় নিকষ পাথর। জঙ্গল অবিন্যস্ত, কিন্তু বড়োই সুন্দর ও মনোরম। প্রকৃতির নিপূণ কারিগরীতে নির্মিত হয়েছে এই স্থানের পরিবেশ, চরাচর। যুবকটি একটি পাথরে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে দূ-রে দেখছিলেন হিমালয় পর্বতমালা। নির্মল নীল আকাশে ভোরের সূর্যদেবের আলোর অসামান্য ছটা।
যুবকটি ব্রাহ্মণ সন্তান। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে হিমালয়ে এসেছেন নিভৃতে দেবাদিদেব শিবের স্তব করবেন বলে। মাত্র কয়েকদিন আগে সম্মুখ যুদ্ধে এক ক্ষত্রিয়ের কাছে পরাজিত ও অপমানিত হয়েছেন তিনি। আর সহ্য করতে পারেননি প্রতিদিনের পরিচিত পরিবেশ। পরাজয়ের পর এক মুহুর্ত অবস্থান করেননি অকুস্থলে। প্রায় তৎক্ষণাৎ শিব ভক্ত যুবক পদব্রজে বেরিয়ে পড়েছেন উত্তর দিকে মুখ করে। বেশ কয়েকদিন অবিরাম পথ চলার পর অবশেষে হিমালয়ের পাদদেশে। এবং নির্জন, নিভৃত একটি স্থানের সন্ধান করতে করতে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ। শিবের স্তব করার জন্য জঙ্গলে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে নিকটবর্তী এক পাহাড়ি ঝর্ণায় স্নান সেরে নিলেন যুবক দধীচি।
পন্ডিত বংশে জন্ম তাঁর। তাঁর পিতা অর্থবন ঋষি রচনা করেছেন অথর্ব বেদ। মাতার নাম চিতি। দধীচি নিজেও স্বয়ং অত্যন্ত পন্ডিত, ভাল মানুষ ও দানী। কিন্তু সম্প্রতি ব্রাহ্মণ সন্তান দধীচি, এক ক্ষত্রিয় নৃপতি ক্ষুভ-এর সঙ্গে প্রকাশ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। উপলক্ষ্য, কে বড় এই প্রশ্নের। ব্রাহ্মণ না ক্ষত্রিয়। প্রথমে উপহাস ও পরে সম্মুখ যুদ্ধে আহ্বান করে নৃপতি ক্ষুভ।
দধীচি অন্যান্য ব্রাহ্মণ সন্তান্দের মতো ক্ষীন চেহারার নন। পান্ডিত্যের পাশাপাশি তাঁর শারীরিক শক্তিও কিছু কম নয়। নৃপতি ক্ষুভের আহ্বানে সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন দধীচি।
এবং সেই যুদ্ধে পরাজিত ও প্রবল ভাবে অপমানিত হন যুবক দধীচি।
অগত্যা শিবের উপাসক দধীচির সামনে একটিই পথ খোলা থাকে। তা হলো, মহাদেবের বর প্রাপ্ত হয়ে এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া।
কঠোর তপস্যা শুরু করলেন দধীচি। দিন গেল, ঋতু পরিবর্তন হলো। অর্থবন ঋষির পন্ডিত ও সাধক পুত্রের এমন তপস্যায় ক্রমেই বিচলিত হয়ে পড়লেন দেবাদিদেব। তিনি অবশেষে তাঁর প্রিয় ভক্তকে তিনটি মোক্ষম বর দিলেন।
ক্ষুভের মুখনিঃসৃত অপমান কিছুতেই বিস্মৃত হতে পারছিলেন না অপমানিত দধীচি। সুতরাং মহাদেব তাঁর প্রিয় ভক্তকে প্রথম বর দিলেন, পান্ডিত্য ও স্বভাবে তুমি এমনই এক পর্যায়ে পোঁছবে যে জীবনে কেউ কোথাও কখনও তোমাকে অপমান করতে পারবে না।
দ্দেবাদিবেব দেবতা-দানব-মানব নির্বিশেষে অনেক অপাত্রে একটি বর দান করে প্রায়শই স্বর্গরাজ্যে হুলস্থুল ফেলে দেন। তা হলো অমরত্ব প্রদান। কিন্তু এক্ষেত্রে সঠিক মানুষকেই বর দিলেন, দধীচি স্বয়ং না চাইলে তাঁর মৃত্যু হবে না। তাঁর ইচ্ছামৃত্যু হবে।
তৃতীয় যে বর দিলেন দেবাদিদেব শিব, তা কখনও কারোকে এর আগে বা পরে দেননি। মহার্ধ এই বরে ব্রাহ্মচ সন্তান দধীচির অস্থি হয়ে উঠলো হিরকের চেয়েও শক্ত – কঠিন, অপরাজেয়।
তিন তিনটি বর পাওয়ার পর মন শান্ত হলো দধীচির। জঙ্গলের ঝর্ণায় স্নান করে নিজ ভূমে যাত্রা করলেন।
এবং স্বভূমে ফিরে প্রথমেই নৃপতি ক্ষুভকে ফিরিয়ে দিলেন তার অপমান। অত্যন্ত সহজ যুদ্ধে তাকে পরাস্ত করে অপমানের শোধ নিলেন পন্ডিত, ধীমান দধীচি।
সময় বয়ে চলে। যুবক দধীচি প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছন। তাঁর আশ্রম তখন নৈমিষারণ্যে সবরমতী নদীর তীরে শান্ত স্নিগ্ধ এক পরিবেশে। সেখানে বহু মুনি ঋষি আসেন জপ তপ ধ্যান ও জ্ঞানার্জনে। তরুন যুবকেরা আসে নানাবিধ গ্রন্থ পাঠে ও শাস্ত্র আলোচনায়। এক অনাবিল শাস্ত্রীয় পরিবেশে স্ত্রী স্বর্চ ও পুত্র পিপ্পলাদকে নিয়ে অতীব শান্তিতে নিজ পাঠ ও সাধন ভজন নিয়ে দিন অতিবাহিত করেন মুনি দধীচি।
মহাদেব শিবের কাছে অসামান্য বর প্রাপ্তির পর শুধু অপমানের জ্বালা জুড়োতে তিনি নৃপতি ক্ষুভকে পরাস্ত করেছেন। তাঁর অন্য প্রাপ্তি নিয়ে কোনও কিছু কখনও ভাবেননি মুনি দধীচি। শিবের বরে তাঁর ইচ্ছামৃত্যু। কিন্তু পন্ডিত প্রবর কঠোর শ্রম শুরু করলেন মধুবিদ্যা আত্মস্থ করবেন বলে। এই বিদ্যাকে বলে ব্রহ্মবিদ্যা। কারণ এই বিদ্যা যে আত্মস্থ করে, তার অমরত্ব প্রাপ্তি হয়।
ইন্দ্রের কাছে তার গুপ্তচর জানালো মুনি দধীচির মধুবিদ্যা নিয়ে সাধনার কথা। ইন্দ্রের ইচ্ছা ছিল, তিনি একা ওই বিদ্যা অধীত করবেন। সুতরাং ক্রোধে প্রায় উন্মত্ত হয়ে ঠিক করলেন, দধীচির মুন্ড ছেদ করবেন। শিবের বরে কেউই অপমান করতে পারেন না দধীচিকে, এবং তাঁর ইচ্ছা মৃত্যু। সুতরাং দেবরাজ ইন্দ্রের দ্বারা কোনও ক্ষতি তাঁর হলো না। দুই উপদেবতা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের কৌশলে ইন্দ্রের প্রাপ্তি হলো একটি অশ্বমুন্ড। আসলে দুই উপদেবতা কারসাজি করে ইন্দ্রকে বিভ্রান্ত করে দেন। ক্রোধে উন্মত্ত দেবরাজের সেই মুহুর্তে তালজ্ঞান লোপ পেয়েছিল।
এর কিছুদিন পর দেবাদিদেব শিবকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করে বৃত্তাসুর হয়ে উঠলো মহাপরাক্রমশালী। কোনও দানব বা অসুর মহাদেব শিবকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করে যে বর প্রার্থনা করে, তা হলো, সে যেন ত্রিলোকে অজেয় হয়ে উঠতে পারে। আর প্রতিটি তপস্যার সময় সংবাদ পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠেন দেবরাজ ইন্দ্র। কারন তিনি জানেন এই সব দুষ্টু লোকের তপস্যার পর বর প্রাপ্তিতে কী অমঙ্গল ধেয়ে আসে স্বর্গ রাজ্যে। প্রত্যকেই অজেয় বর প্রাপ্তির পর স্বর্গ আক্রমণ করে।
বৃত্তাসুরের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। বর প্রাপ্তির পরেই সে আক্রমণ করলো স্বর্গরাজ্য। ইন্দ্র ও অন্য দেবতারা পরাস্ত হয়ে বাধ্য হলেন দেব লোক ত্যাগ করে পলায়ন করতে।
উদ্ভ্রান্ত ইন্দ্র ও অন্য দেবতারা এক্ষেত্রে যা করেন, এবারও তাইই করলেন। তারা শরণাপন্ন হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার। ব্রহ্মা জানালেন, মহাদেব শিবের বরে অমর ও অপরাজেয় বৃত্তাসুর স্বর্গ- মর্ত্য-পাতালের কোনও অস্ত্রেই ঘায়েল হতে পারে না। তার জন্য চাই অভূতপূর্ব কোনও অস্ত্র। আর ওই অস্ত্র হতে পারে এমন কোনও বস্তুতে, যা অভাবনীয়। যা ইতোমধ্যে মহাদেব শিবের বর প্রাপ্ত।
এর অর্থ বোধগম্য হলো না ইন্দ্র ও অন্য দেবতাদের।
প্রজাপতি ব্রহ্মা বললেন, কোনও সাধারণ ধাতু নির্মিত অস্ত্রে বৃত্তাসুরের কোনও হানি হবে না। বৃত্তাসুরের মাথায় মহাদেবের আশীর্বাদ রয়েছে। সুতরাং এই পরাক্রমের উত্তর খুঁজতে হবে মহাদেবেরই অন্য আশীর্বাদকে স্মরণ করে।
কী সেই আশীর্বাদ? ব্রহ্মা বললেন, সবরমতী নদীর তীরে মুনি দধীচির শরীরের অস্থি শিবের বরে অসামান্য। ওর চেয়ে কঠিন বস্তু ত্রিলোকে নেই। মুনি দধীচি যদি তাঁর শরীরের অস্থি দান করেন, তবে ওই অস্থি দিয়ে যে অস্ত্র নির্মান করবেন বিশ্বকর্মা, তার হবে এক অতুলনীয় শক্তির। এই অস্থি প্রাপ্তি তখনই সম্ভব, যখন স্বয়ং মুনিবর ইচ্ছামৃত্যু কামনা করে দেহত্যাগ করবেন।
একদা দধীচির মস্তক কর্তন করতে আসা ইন্দ্র পড়লেন মহা সমস্যায়। ব্রহ্মা অবশ্য তাঁকে ও অন্য দেবতাদের আশ্বস্ত করে জানালেন, মুনি বর শুধু মহা পন্ডিত ও শক্তিমানই নন, মুনি দধীচি অত্যন্ত সদয় প্রকৃতির। বড় মনের মানব। তাঁর হৃদয় প্রশস্ত ও বিশাল। ইন্দ্র কোনও রূপ দ্বিধা না করে তাঁর অর্থাৎ ব্রহ্মার নাম স্মরণ করে কথাটি তাঁকে বলতে পারেন।
দেবতারা একত্রে হাজির হলেন সবরমতী আশ্রমে। মুনি দধিচি দেবরাজ ইন্দ্রকে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করে জানতে চাইলেন, কী সমস্যা।
দধীচি মুনি পুরোনো কথা স্মরণে রাখেননি। বরং ইন্দ্র ও অন্য দেবতাদের চেহারা ও মুখাবয়ব দেখে তাঁর কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তা ও করুণার উদ্রেক হলো। তিনি প্রসন্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের আগমনের হেতু কী?
সসংকোচে ইন্দ্র তাদের অভিপ্রায় জানালেন। সিদ্ধান্ত নিতে লহমা মাত্র নিলেন না মুনি দধীচি। বললেন, একটা সময় আসে, যখন জীবন স্তব্ধ হয়। সামান্য বিশ্রামে শরীর ও মন তৃপ্ত হয় না। তখন চির বিশ্রামের প্রয়োজন পড়ে। তাছাড়া দেবাদিদেব শিবের বরে আমি অক্লান্ত প্রাণ ধারণ করে যেতে পারি। কিন্তু এমন আহ্বান আপনারা নিয়ে এলেন, যা খুবই জরুরী এবং স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। নৃশংস দানব বৃত্তাসুরকে পরাস্ত করার এই একটিই যখন পথ এবং এই পথ আমারই ইচ্ছাধীন, তখন আমার এই নশ্বর শরীর ত্যাগে কোনও দুঃখ নেই।
দেবতাদের সম্মুখে যোগবলে প্রাণ ত্যাগ করে বিষ্ণুলোকে যাত্রা করলেন মুনি দধীচি।
আর তাঁর অস্থি দিয়ে বৃত্তাসুর বধের অমোঘ অস্ত্র নির্মাণ করে দিলেন বিশ্বকর্মা। অতঃপর বৃত্তাসুর বধ সম্পন্ন হলো। দেবতারা ফিরে পেলেন তাদের স্বর্গরাজ্য।।