আত্মকথা - অনািদনাথ মাহাত

শুরু করছি আমার ব্যক্তিগত অতীত জীবনের কথা। আমার জন্মদিবস ৩-রা জানুয়ারী ১৯৪৫ সাল। 
প্রাথমিক শিক্ষা ঃ
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের শেষকাল পর্যন্ত অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতালাভের সমসাময়িক কাল পর্যন্তও কুড়মি জনজাতি বহুল গ্রামীণ সুবিস্তৃত এতদঞ্চলীয় এলাকাতে স্কুল ছিলই না। কারণ কুড়মিদের সহজাত মানসিকতার মধ্যে অন্তত সেকালে 'মাটি-গোবর' ভরে ছিল। তাই তাঁরা যেখানেই বসতি স্থাপন করতেন সেখানেই কৃষির উপযোগী 'কৃষিক্ষেত্র' (Agricultural field) তৈরী করতেন ঠিকই কিন্তু ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার উদ্দেশ্যে কোন 'শিক্ষাক্ষেত্র' (Educational field) তৈরীর কোন প্রচেষ্টাই করতেন না। 
অথচ বিপরীতভাবে দেখা যায় যে সব গ্রামে দু-দশটিও শিক্ষিত বাঙালী প্রভৃতির বসবাস গড়ে উঠত সেখানেই তাঁরা স্ব-প্রচেষ্টায় ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য নিশ্চিতরূপে অন্তত একটি স্কুলের স্থাপনা অবশ্যই করতেন। আর তাই দেখা যায় স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত মহলের মধ্যে যেমন শান্তি ফিরে আসতে থাকে, তাঁরা তখন নিজ-নিজ  প্রচেষ্টায় স্কুল খুলতে শুরু করে দেন। আর এমনিভাবে জানতে পারা যায় যে পিঠাজোড় বস্তিতে যে পাঁচ-সাতটি শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পরিবার (ব্যানার্জি ও দেওঘরিয়া ব্রাহ্মণ) বসতি স্থাপন করেছিলেন তাঁদের উদ্যোগে পিঠাজোড় নিম্ন প্রাথমিক স্কুলের স্থাপনা হয়েছিল স্বাধীনতালাভের ঠিক পরবর্তীকালে। 
বলাবাহুল্য, ঐ স্কুলেই প্রায় ৬/৭ বছর বয়সে ১৯৫০-৫১ সালে আমার হয় শিক্ষারম্ভ —'হাতেখড়ি'। স্কুলে শিক্ষক ছিলেন দুজন। তাঁদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক ছিলেন ঐ পিঠাজোড় বস্তিরই বাসিন্দা নকুল ব্যানার্জি যিনি গাঁয়ের লোকজনসহ আমাদের কাছেও 'বড়পণ্ডিত' নামেই সুপরিচিত ছিলেন। অনুরূপ সহায়ক শিক্ষক পার্শ্ববর্তী গ্রামের গৌর দাস (বৈষ্ণব) সকলের কাছে 'ছুটু পন্ডিত' নামেই সুপরিচিত ছিলেন। আজও মনে পড়ে, প্রত্যহ স্কুলের পড়া শুরু হওয়ার আগে আমাদিগকে সমবেতভাবে জোরে জোরে ধারাপাতের সংখ্যাগণনা, বুড়ি, গন্ডা, পণ, চোক, কাঠা, সের, নামতা ইত্যাদি আবৃত্তি করতে হত। আর যে পড়া করতে পারত না তাকে পন্ডিতদের কাছ থেকে কানমলা, পেন্সিল দিয়ে পেটের চামড়া মলে দেওয়া, চড়-থাপড় এমনকি চাবুকের মারও খেতে হত। আরও মনে পড়ে, স্কুল ঘরটি যেহেতু ছিল খড়ে ছাওয়া মাটির তৈরি তাই প্রতি শনিবার আমরা সবাই পার্শ্ববর্তী মাঠ থেকে গোবর লেপে পরিষ্কার করতাম। আর এর পরই শনিবারে স্কুল ছুটি হয়ে যেত। প্রসঙ্গতঃ আরও মনে পড়ে, প্রত্যহ  মাড়-জল যাই হোক খেয়ে দেয়ে সূর্যের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে নিজের ছায়াকে পা মেপে মোটামুটি দশ-সাড়ে দশটার সময় স্কুল যেতাম। বগলে থাকত একটা ছেঁড়া কাপড়ে বাঁধা শ্লেট ও পড়ার ছেঁড়া-ফাটা বই। কাঁধে থাকত স্কুলে মেজেতে পেতে বসার জন্য একটা ছেঁড়া বস্তা (চট)। পরণে থাকত হাফ‍্ প্যান্ট ও হয়তো বা ময়লা-সয়লা হাফ‍্ হাতা জামা। খালি পায়ে বহাল (Low-paddy field) পেরিয়ে মাইল খানেক দূরের স্কুল যেতে হত। যাই হোক এইভাবে  ১৯৫৩-৫৪ সালে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত গ্রামের স্কুলের পড়াশোনা শেষ করলাম। আমার বয়স তখন ১০/১১ বছর হলেও আমিই ছিলাম আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ছোট। অন্য সহপাঠীরা আমার অপেক্ষায় অন্ততঃ তিন-চার বছরের বড় ছিল। কাজেই স্বাভাবিক কারণেই আমাকে শান্ত, সাধাসিধে হয়েই থাকতে হত।
উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষা 'ইর‍্গা উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়' ঃ— 
গ্রামের স্কুল থেকে নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষা ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পাশ করার পর মাইল তিনেক দূরবর্তী 'ইর‍্গা উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৫৪ সালে ক্লাস ফোরে ভর্তি হই। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এই ইর‍্গা স্কুল থেকে ২ বছর পর ১৯৫৫-৫৬ সালে ক্লাস ফাইভ‍্ পাশ করি। এই স্কুলেও প্রত্যহ খালি পায়ে হাফ‍্ প্যান্ট ও হাফ‍্ জামা পরে কাঁখ-বগলে কাপড় ছেঁড়াতে বাঁধা বই-খাতা ও কাঁধে স্কুলে বসার জন্য বস্তা ছেঁড়া নিয়ে যেতে হত। আর স্কুল যাওয়া-আসার সময় পিঠাজোড়ের পূর্বদিকস্থ বাঁকজোড় নদী, দুটি বিস্তৃত মাঠ ও একটি বহাল পেরিয়ে যেতে হত। আজও মনে পড়ে, স্কুল যাওয়া-আসার সময় বাঁকজোড় নদীর শ্মশানে কতবার মড়া-খেকো শিয়াল-শুগলি কুকুরকে পাথর ছুঁড়ে তাড়াও করেছি। বর্ষাকালে স্কুল যাওয়া-আসার সময় সঙ্গী-সাথীর সঙ্গে বানে ঝাঁপ দিয়ে খেলাও করতাম। 
মালথোড় জুনিয়ার (প্রস্তাবিত) হাই ইংলিশ স্কুলের শিক্ষা ঃ— 
পূর্বোক্ত ইর‍্গা উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ক্লাস ফাইভ‍্ পর্যন্ত পড়ার পর ১৯৫৬ সালে পিঠজোড়ের দক্ষিণদিকস্থ মাইল ৫/৬ দূরবর্তী মালথোড় গ্রামে দুর্গামন্দির প্রাঙ্গনে স্থাপিত প্রস্তাবিত জুনিয়ার হাই ইংলিশ স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই। স্কুল আর পিঠাজোড়ের মাঝে 'দুধপানি আক জঙ্গল' (দুধপানিয়ার জঙ্গল) নামে সেকালে একটি ভয়ঙ্কর জঙ্গল ছিল এবং ঐ জঙ্গলেরই দক্ষিণপূর্ব কোণে 'ঘড়াটাঙ্কা আমগাছ' নামে একটি আমগাছ ছিল। ঐ মালথোড় স্কুলের ক্লাস সেভেনের আমরাই ছিলাম প্রথম ব্যাচের ছাত্র। যাইহোক মালথোড় স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ক্লাস সেভেন পাশ করি। 
উদয়পুর (প্রস্তাবিত) জুনিয়ার হাই ইংলিশ স্কুলের শিক্ষা ঃ—
মালথোড় স্কুল থেকে ক্লাস সেভেন পাশ করার পর আমার গ্রাম পিঠাজোড় থেকে প্রায় মাইল আটেক উত্তরস্থিত উদয়পুর স্কুলে ১৯৫৮ সালে ক্লাস এইটে ভর্তি হই। অনেক কষ্ট করে উদয়পুর স্কুলে এক বছর পড়ার পর ১৯৫৯ সালে ঐ স্কুল থেকে ক্লাস এইট‍্ পরীক্ষায় পাশ করি। 
শিবনারায়ন হাই ইংলিশ স্কুল, পাড়াতে শিক্ষা ঃ— 
এইভাবে ১৯৫৯ সালে উদয়পুর জুনিয়ার হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ক্লাস এইট‍্ পাশ করার পর ১৯৫৯ সালে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হয় গ্রাম থেকে প্রায় মাইল দশেক দূরবর্তী বর্তমান পাড়া থানার দক্ষিণ পার্শ্বস্থিত 'ইন্দচাঁড়' নামক স্থানে পরিচালিত 'পাড়া শিব নারায়ণ হাই ইংলিশ স্কুলে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে আমার গ্রাম পিঠাজোড়ের উত্তর পার্শ্ববর্তী 'রাঙ্গামাটিয়া' গ্রামে হল আমার মামার বাড়ী। এই মামাবাড়ী থেকে পাড়া স্কুলের দূরত্ব হল প্রায় মাইল সাতেকের মতো। আর ঐ সময়কালে আমাদের সংযুক্ত পরিবারের আর ৫/৬ জন খুড়তুতো ভাইয়েরা বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনা করত। তাই এই অবস্থায় মামাবাড়ীতে থাকাকালীন সময়ে ঐ গ্রাম থেকে ১০/১২ জন ছেলে পায়ে হেঁটে স্কুল যাওয়া-আসা করত বলে আমিও তাদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া-আসা করতাম। তবে বর্ষাকালে পাড়ার পশ্চিমদিকস্থ হাড়াই নদীতে বান নামলে সেদিন আর স্কুল যাওয়া হত না। এইভাবে পাড়া স্কুলে পড়ার সময় শেষের বছরখানেক স্কুল হষ্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছিলাম। আর এমনিভাবে কষ্টে-সৃষ্টে ১৯৬২ সালে আমি স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষাতে পাশ করি। 
জে. কে. কলেজ, পুরুলিয়া থেকে ইউ. ই. সি-র শিক্ষা ঃ—
পাড়া স্কুল থেকে স্কুল ফাইন্যাল পাশ করার পর পুরুলিয়া জে. কে. কলেজ থেকে ১৯৬২-৬৩ সালে ইউনিভারসিটি এন্ট্রান্স কোর্স (একবছরের পাঠক্রম) পাশ করি।
পি. কে. রায় মেমোরিয়্যাল কলেজ, ধানবাদে শিক্ষালাভ ঃ— 
উপরোক্তভাবে আমি যখন জে. কে. কলেজ পুরুলিয়া থেকে ইউ. ই. সি. পাশ করলাম তখন আমার 'বড়দাদা' পি. কে. রায় মেমোরিয়্যাল কলেজে ত্রিবর্ষীয় ডিগ্রী কোর্সে ১৯৬৩ সালে আমাকে ভর্তি করে দেন। তবে তখন দাদা থাকতেন ধানবাদ কোর্ট থেকে প্রায় ৬/৭ মাইল পশ্চিমে ভুলি টাউনশিপের কোয়ার্টারে। আর সেখান থেকে পি. কে. রায় কলেজের দূরত্ব  হল অন্ততঃ মাইল দশেক। তাই বেশিরভাগ দিনই ধানবাদ-গুমো রেল লাইনের পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে যে কলেজ যাওয়া আসা করতাম সেকথা আজও ভুলিনি। তবে আমি যখন ডিগ্রী ফাইন্যাল ইয়ারে পৌঁছালাম তখন দাদা হিরাপুর ধানবাদে কোর্ট কোয়ার্টারে Shift করেন। তাই আমারও কলেজে পড়ার আর বিশেষ অসুবিধা হয়নি। কিন্তু সে যাই হোক এইভাবে ১৯৬৬ সালে আমি কোনরকমে ‍B. A. Hons. (Bengali) Second Class -এ পাশ করি। 
সাংসারিক বিপর্যয় ক্রম ঃ 
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আমাদের পারিবারিক অবস্থা তখন মোটেই ভালো ছিল না। কারণ দাদুদের পরলোকগমনের পর ১৯৬৪ সালে আমাদের সংয়ুক্ত পরিবার ভেঙ্গে গিয়েছিল। বাবা-কাকারা তিনভাই-ই তখন পৃথগন্ন এবং ঐ সময়কালে আমাদের পৃথক পরিবারে কৃষিকার্যের  গুরুদায়িত্ব তখন পড়েছিল প্রায় ৬৪/৬৫ বছরের বয়োবৃদ্ধ বাবার ঘাড়ে। আর তাই কলেজে পড়াশোনা কালীন সময়ে যখন ছুটি-ছাটা উপলক্ষ্যে বাড়ীতে যেতাম তখন সাধ্যমত খেতে-কামারে কাজ করে সহযোগিতাও করতাম। তবে বার্ধক্যজনিত কারণে বাবা চাষের কাজের জন্য কঠিন পরিশ্রম করতে পারতেন না বলে কৃষির কাজ মুনিশজনের উপরই ছিল নির্ভরশীল। আর এইভাবে যে পরিমাণে ধান, রবিশস্য প্রভৃতি উৎপাদিত হত তার অধিকাংশই বারমাস্যা বাগাল-মুনিশ, ধান্যরোপন, ধান্য-কর্তন, ফসল মাড়াই-ঝাড়াই প্রভৃতি কাজে নিযুক্ত কামিন-মুনিশের মাহিনা ও খাওয়া দাওয়ার পিছনেই ব্যয় হত। কাজেই যখনই নগদ অর্থের প্রয়োজন  হত তখন ধান সুদের পরিবর্তে হ্যান্ডনোট লিখে দিয়ে গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে বাবাকে অর্থ সংগ্রহ করতে হত। সে সব ব্যাপার আমি নিজেও দেখেছি। এই তো হল সংক্ষেপে আমাদের গ্রামীণ গার্হস্থ্য দুরাবস্থার কথা। 
অপরদিকে দেখা যায় ধানবাদ সিভিল কোর্টে কর্মরত বড়দাদার আর্থিক অবস্থাও সেইকালে কোনরকমে দিন কাটানোর মতই যে ছিল সে-সবও আমি স্বয়ং দেখেছি। কারণ তখন বাসাতে ছোট-বড় সব মিলে আমরা নয়জন থাকতাম। দাদা-বৌদি, দাদার তিন মেয়ে, দুজন ছেলে ছাড়া আমি এবং আমার ছোটভাই গিরিধারীও দাদার উপার্জনের উপরই নির্ভরশীল  ছিলাম। দাদার ছেলে-মেয়েদের স্কুল কলেজের লেখাপড়ার খরচের সঙ্গে আমার ও ছোটভাই গিরিধারীর খাওয়া-পরার সঙ্গে সঙ্গে কলেজে পড়ার খরচ তো দাদাকে সামলাতে হতই তদুপরি পি. কে. রায় মেমোরিয়্যাল কলেজে (সান্ধ্যকালীন) শিক্ষাপ্রেমী দাদার নিজেরও বি. এ. পড়াশোনার খরচাদিও ছিল। আর তাই খোলামনে স্বীকার করি যে,  আমাদের পরিবারের গ্রাম্য ও শহুরে জীবন কোনটাই সুবিধাজনক ছিল না। 
পাটনা ইউনিভারসিটিতে আমার শিক্ষালাভ ঃ—
বলা বাহুল্য, উল্লিখিত পারিবারিক শোচনীয় অবস্থায় ইউনিভারসিটিতে উচ্চ শিক্ষালাভের চিন্তা-ভাবনা স্বাভাবিক কারণেই আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম। তবে কথা প্রসঙ্গে বাবা যখন জানতে পারলেন যে, আমার এম. এ. পড়ার ইচ্ছা আছে তখন তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমাকে এম. এ. পড়ানোর জন্য হাসিমুখে রাজী হয়ে যান। কারণ বাবার মধ্যে ছিল দাদুর মতই শিক্ষার প্রতি একটা অপরিসীম আগ্রহ। আর তাই আমি যখন আমাদের পারিবারিক অর্থাভাব — অভাব-অনটনের কথার উল্লেখ করে পড়া ছেড়ে দেওয়ার কথা বাবাকে শুনিয়েছিলাম তখন তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে শুধু বলেছিলেন —"মোটে দু'বছর পড়ার কথা তো, সেটা আমি দেখে নিব।" 
যাই হোক শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬-৬৮ সেশনে আমি পাটনা ইউনিভারসিটিতে 'বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ'-এ ভর্তি হই। পাটনা সায়েন্স কলেজের দক্ষিণপার্শ্বস্থিত গঙ্গানদীর তীরবর্তী 'দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং' -এ আমাদের ক্লাস চলত আর অবসর সময়ে গঙ্গার তীরে বসে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে গল্প-স্বল্প করতাম। পাড়াগ্রামের ছেলে হওয়ার কারণে নদীতে, বাঁধে সাঁতার কাটার অভ্যাস তো আমার ছিলই তাই মাঝে-মধ্যেই গঙ্গানদীতে স্নানের অবকাশে অনেকবার সাঁতারও কেটেছি। কিন্তু সবই আজ ইতিহাস। পাটনাতে থাকাকালীন সময়ে ইউনিভারসিটি হস্টেলে থাকতাম।
আজও মনে পড়ে, বাংলা এম. এ. ক্লাসের প্রথম দিনের তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা। গরীব চাষি ঘরের ছেলে হয়েও আমি এম. এ পড়ছি বলে মনে আমার আনন্দের আর শেষ নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের তখন প্রধান অধ্যাপক (H.O.D)  ছিলেন স্বনামধন্য ভাষাতত্ত্ববিদ‍্ ড. সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল মহাশয়। তিনি ক্লাসে এসে প্রত্যেকেরই পরিচয় নেওয়ার পর শিক্ষামূলক কিছু বক্তব্য দেওয়ার পর সবাইকে জানালেন হার্দিক অভিনন্দন ও শুভকামনা। এতক্ষণ পর্যন্ত তো মন খুশীতেই ভরে ছিল। কিন্তু ক্লাস শেষ হওয়ার পর যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম তখন দেখলাম আমারই ক্লাসের পাঁচ-ছয়জন ছাত্র-ছাত্রী আমার দিকে লক্ষ্য করে ফিক‍্ফিক‍্ করে হাসছে। আমি তখন কিছু বুঝতে পারিনি। পরে আমারই সঙ্গে পাঠরত ধানবাদ কলেজের বন্ধু ভূতনাথ দাসের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, আমার গেঁয়ো (Rural) শান্ত স্বভাব ও চাকচিক্যহীন তথা দারিদ্র্য-ব্যঞ্জক সাদারণ পোষাক-পরিচ্ছদই ছিল ঐ সব ছাত্র-ছাত্রীদের উপহাসের কারণ। পাটনাতে ভর্তি হওয়ার আগে ধানবাদের কলেজ জীবনে আমার পোষাক ছিল — চাইনিজ শার্ট, পায়জামা ও পায়ে চটি। বলাবাহুল্য ঐ সব পোষাক-পরিচ্ছদ পরেই আমি প্রথমদিন ক্লাসে যাওয়ার কারণেই রাজধানী পাটনাবাসী অভিজাত্যাভিমানী ছাত্র-ছাত্রীরা সেদিন আমাকে যে তাচ্ছিল্যের নজরে দেখেছিলেন সে কথা আজও ভুলতে পারিনি। কিন্তু সে যাই হোক তারপরই বন্ধু ভূতনাথ দাসের পরামর্শে আমি প্রথম শার্ট-ফুলপ্যান্ট পরতে শুরু করি। কিন্তু এসব থাক। 
অতঃপর সংক্ষেপে কিছু কথা বলে আমার শিক্ষাজীবনের প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই। পাটনাতে এম.এ. বাংলা পড়াকালীন সময়ে বীরভূম, রামপুরহাটের সিরাজ আহমদের সাথে বন্ধুত্ব হয়। সে তখন 'পাটনা ল কলেজ' থেকে বি.এল. (ব্যাচেলার অফ্ ল) করছিল। ক্লাস চলত সন্ধ্যায়। তাই সিরাজ আহমদের দেখাদেখি আমিও সান্ধ্যকালীন ল কলেজে বি.এল.-এ ভর্তি হয়ে যাই। এম.এ.-এর মাসিক ফি ছিল সাড়ে বারো টাকা এবং বি.এল.-এর মাসিক ফি ছিল পনেরো টাকা। এছাড়াও ছিল হোস্টেলের খরচা, দৈনন্দিন দোকানপাটের খরচা, বই-খাতা-পত্রের খরচা, ছুটিছাটাতে বাড়ী যাওয়া-অাসার খরচা প্রভৃতি। সত্যি কথা বলতে কি পারিবারিক অর্থাভাবের জন্যই পাটনাতে খুবই হিসেবী জীবনযাপন করতে হত। একটা ডায়েরীতে দৈনন্দিন খরচার কথা লিখে রাখতাম। খুঁজলে আজও সেইসব হিসাবপত্রের ছেঁড়াফাটা ডায়েরী পেতেও পারি। যাই হোক, সব কিছু মিলিয়ে আমার খরচা ছিল সওয়া-শ' থেকে দেড়শ' টাকা। তবে এই সময়কালে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত দু'বছর ধরে রাঁচী ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে প্রতি মাসে Merit-cum-Poverty Scholarship রূপে পঞ্চাশ টাকা পেতাম। অবশিষ্ট শ'খানেক টাকার মধ্যে বেশীর ভাগই পেতাম বড়দাদার কাছ থেকে। তাছাড়া গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ধানসুদের শর্তে নগদ টাকা ঋণ নিয়ে বাবাও প্রায়ই আমাকে টাকা দিতেন। এমনকি অামি নিজেও পাটনাতে থাকাকালীন সময়ে বাংলা বিভাগের এক অধ্যাপিকা মিসেস এল. কে. ঘোষ, যিনি সাধারণত ছাত্রমহলে 'মাসীমা' নামেই সুপরিচিত ছিলেন তাঁর বাড়ীতে ছেলে-মেয়েদের টিউশন পড়িয়েও হাত-খরচের মত কিছু টাকা পেতাম। যাই হোক, এমনিভাবে কষ্টেসৃষ্টে ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় বিভাগে (Second Class) বাংলায় এম.এ. এবং বি.এল. (ব্যাচেলার অফ্ ল) পাস করার পর আমার কষ্টসাধ্য শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। সত্যি কথা বলতে কি আমার নাতি-নাতিনীরাও আমার অতীত শিক্ষাজীবনের অভাব-অনটনের কথা যখন শোনে তখন বিস্ময়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কারণ বর্তমান কালের Computer ও Electronic-এর যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে আমাদের অতীতের কথাকে নিছক গল্প বলে মনে করাই তো স্বাভাবিক। কারণ generation gap-এর কথাকেও তো কোনক্রমেই অস্বীকার করার জো নেই।
আমার কর্মজীবন ঃ-
l ধানবাদ সিভিল কোর্ট ও পুরুলিয়া কোর্টে ওকালতি — আমার কর্মজীবন শুরু হয় ধানবাদ সিভিল কোর্টে ১৯৭১ সালে ওকালতি করার কাজ থেকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে 'বিনোদবাবু' নামে সর্বজনপ্রিয় স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ তথা আইনজীবি বিনোদ বিহারী মাহাত মহাশয়ের অন্যতম জুনিয়ার উকিল হিসাবে আমি ওকালতি শুরু করি। কিন্তু ধানবাদ কোর্টে বছর চারেক ওকালতি করার পর ১৯৭৫ সালে আমি পুরুলিয়া কোর্টে ওকালতি শুরু করি। উদ্দেশ্য ছিল আমার গ্রামে থেকে প্রায় মাইল পনেরো দূরস্থিত পুরুলিয়া কোর্টে ওকালতি করার সঙ্গে সঙ্গে যথাসম্ভব গৃহস্থালির কাজকর্ম তথা বৃদ্ধ পিতামাতার দেখাশোনা করা। কারণ বাবার বয়স তখন প্রায় সত্তর বছর। কাজযোগ মোটামুটি ভালোই চলছিল।
l 'চাস কলেজ, চাস, বোকারো'-তে অধ্যাপকের কাজ — সত্য কথা বলতে কি ওকালতির কাজ করার মত সাধারণ গুণ আমার ধাতে একেবারেই ছিল না। ছল-চাতুরী করে সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য রূপে সাব্যস্ত করার মত মানসিকতা আমার ছিলই না। আর তাই ১৯৭৬ সালে চাস কলেজের স্থাপনা হওয়ার পর আমি 'বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ'-এ প্রধান অধ্যাপকের কাজ করতে শুরু করি। মনে তখন আনন্দের বন্যা শুরু হয়। কলেজে ছাত্রদের শিক্ষাদান করার সূত্র ধরে আমিও অন্ততঃ মানুষের জীবনে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রভৃতির গুরুত্ব সম্পর্কে নানান ধরণের নতুন নতুন শিক্ষালাভ করতে থাকি। ভাষা কি? ভাষার উদ্ভব রহস্য কি? ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক কি? সাহিত্য কি? ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কেমন করে আদিম গোষ্ঠীসমূহের স্বাতন্ত্র্যের ইতিহাসের অনুসন্ধান করা যায়? ইত্যাদি ইত্যাদি নানান বিষয় সম্পর্কে কলেজের কর্ম জীবনে অনেক কিছুই জানতে পারি।
প্রসঙ্গতঃ খোলামনে স্বীকার করি যে, কলেজে অধ্যাপনার কাজ না করে যদি ওকালতি পেশা নিয়ে থেমে যেতাম তাহলে আমার গোটা জীবনটা শুধু মিথ্যার বেসাতি করেই কেটে যেত। শিক্ষাদীক্ষার অভাবজনিত কারণে নিজেদের গোষ্ঠীগত আদিম ও ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীত ইতিহাস — গোষ্ঠীগত পরিচয় সম্পর্কে তাঁরা একেবারেই ছিলেন অজ্ঞাত — অজানা। আর এমনিভাবে আমার নিরক্ষর পূর্বপুরুষেরা যেমন আবহমান কালাবধি ধরে মাটির সঙ্গে জীবনযাপন করে শেষে মাটিতেই নিশ্চিহ্নভাবে মিশে গেছেন, কলেজে অধ্যাপনার কাজ না করলে, আমিও নিজেদের গোষ্ঠীগত পরিচিতি সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞাত অবস্থাতেই একদিন মাটির সঙ্গে মিশে যেতাম সেকথা আমি খোলামনেই স্বীকার করি। যাই হোক, আমি নিজেকে চিনতে পেরে সত্যই গর্ববোধ করি।