অতিমারী হল এমন মড়ক যাতে কোন রোগ-ব্যাধির সংক্রমণে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। এতে মানবমনে এক ভয়ানক আতঙ্কের আবহ সৃষ্টি হয়। বাঁচবার তাগিদে মানুষ নিজের বাসস্থান ত্যাগ করে কোন নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।
বয়স্কদের কাছ থেকে শুনেছি কোন পাড়ায় বা গ্রামে কেউ কলেরা বা বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে প্রতিবেশীরা বা পাড়া/গ্রামের লোকেরা সেই পাড়া বা গ্রামের লোকদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখতেন না। আক্রান্ত এলাকার মানুষদের সঙ্গে উঠবস করতেন না। যখন শুনতেন অমুক পাড়ার লোকেরা পরপর মরছে, অসুস্থ হয়ে পড়ছে, তখন প্রতিবেশীরা বা পাশের পাড়ার লোকেরা ভয়ে বাঁচার জন্য অন্য জায়গায় চলে যান। সেখানেই নতুন করে জীবনযাপন শুরু করেন।
একসময় সর্দি-কাশি-জ্বর সহ মারাত্মক রোগব্যাধির জন্য মানুষগুলো জঙ্গলি ঔষধ বা জুড়িবটি ব্যবহার করতেন এবং সুস্থ হয়ে উঠতেন। তবে কলেরা বা বসন্তের মত অতিমারী রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য অর্থাৎ যাতে পাড়ায় বা গ্রামে ঐ রোগের প্রাদুর্ভাব না ঘটে সেইজন্য আদিবাসীরা গাঁওপূজা (গ্রামপূজা) বা মায়পূজা করে থাকেন।
প্রত্যেকটি আদিবাসী পাড়ায় 'মায় থান' (মাটির তিনটি দলার বেদী) আছে। এই থানে আষাঢ় মাসে মায়পূজা করা হয়। এই পূজায় একটি কালো পাঁঠা ও একজোড়া পায়রার বাচ্চার প্রয়োজন হয়। গাঁয়ের সকলে মিলে এই পূজাটি করে থাকে। তাই একে গাঁওপূজা বলা হয়ে থাকে। পাড়ার পাহান (আদিবাসী পুরোহিত/পূজারী) গাঁওপূজা বা মায়পূজা সম্পন্ন করেন। কোন ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না।
পাহান বেদীর সামনে হাঁটুগেড়ে করজোড়ে এই বলে প্রার্থনা করেন, "হে কলেরা, বসন্ত এবং আরো অন্যসব ব্যাধি ! তোমরা আমাদের গাঁয়ে কখনও আসবে না। কখনও সংক্রমণ ছড়াবে না। তাই তোমাদের উদ্দেশ্যে এই কালো পাঁঠা বলি দিচ্ছি। আর ধর্মেশ (ভগবান)-এর উদ্দেশ্যে বলেন, "তুমি আমাদের গাঁয়ের সবাইকে (মানুষ সহ গৃহপালিত প্রাণীসমূহ) সুখে শান্তিতে রেখো। কোন অশুভ দৃষ্টি আমাদের কোনরূপ ক্ষতি বা প্রাণহানি করতে না পারে। সেইজন্য এই পায়রা জোড়া তোমার নামে বলি দিচ্ছি।"
আদিবাসীরা যে সকল খাবার খায় সেগুলি এখানে উল্লেখ করা হল ঃ —
(১) ভাত, রুটি, মাড়ুয়া (বাজরা), মাছ, দুধ, মধু, ডিম এবং মাংস। মাংসের মধ্যে পড়ে হাঁস, মুরগী, ছাগল, পাঁঠা, শিয়াল, ইঁদুর, বেজি, বাদুড়, সজারু, পেঁচা, খরগোস, কচ্ছপ, বনবিড়াল, শুয়োর, পায়রা, বাজপাখি ইত্যাদি।
(২) বাড়কা ঘুংঘি (শামুক), ছোটকা ঘুংঘি (গুগলি), ঝিনাই (ঝিনুক), কুঁচিয়া (কুঁচো), কাঁকড়া।
(৩) বোথাল ভাত (জল দেওয়া ভাত), বাসি ভাত (রাতে ভাতে জল দিয়ে রাখা হয়। পরের দিন সেই ভাত লংকা, পেঁয়াজ, লবণ দিয়ে খাওয়া হয়)।
(৪) কতিপয় শাগ (শাক) যেমন, কচুশাক, গিমা (তিতা জাতীয় শাক), ভাথুয়া (বেতো/ বোতে), নিরবিসনা (চামঘাস), মুচরি (হেলেঞ্চা), সজনা/সজনে শাক, পাট শাক, শুনশুনিয়া (ছাতা শাক/শুশনিয়া)।
আরো কিছু খাবার ঃ কলাগাছের থোড়, মোচা, ডুমুর, আমড়া, তেঁতুল, আমসি ( আমচুনা), খুখড়ি (ব্যাঙের ছাতা), ঠুড়হু (শালুক), কারিল (যে নতুন চারা বাঁশটি মাটি ভেদ করে এক হাত বা দেড়হাত উপরে উঠেছে)।
পানীয় খাবার ঃ হাঁড়িয়া (পচালি), মহুয়ার দারু, খেজুরের ও তালের রস।
মাটির নীচের খাবার ঃ আরু কানদা (মাটি আলু), শুতলি কানদা (লম্বা লম্বা মিষ্টি জাতীয়।
আদিবাসীরা এই সকল খাদ্যবস্তু খায়। ফলে যেমন তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়ে, তেমনি তারা দৈহিক পরিশ্রম করতে বেশ সক্ষম। আমার মনে হয় উপরোক্ত খাদ্য গ্রহণের কারণে তাদের মধ্যে রাতকানা, রিকেট, প্যারালাইসিস, ক্যানসার প্রভৃতি রোগ-ব্যাধি খুব কমই দেখা যায়। এমন কি অতিমারীতেও তারা তেমন সংক্রামিত হন না বা মারা যান না।
আদিবাসী হোক বা অ-আদিবাসী হোক যারা শহর/নগর থেকে দূরে গ্রামেগঞ্জে, পুকুর-নদী, সবুজ গাছপালা পরিবেষ্টিত পরিবেশে বসবাস করেন যেখানে অফুরন্ত সূর্যের আলো, নির্মল বাতাস খেলা করে সেখানে রোগ-ব্যাধি দেখা দিলেও তা মহামারীর আকার নিতে পারে না। ভয়ানক অতিমারী করোনার ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে জনাকীর্ণ শহরের তুলনায় গ্রামে-গঞ্জের মানুষরা খুবই কম সংক্রমিত হয়েছেন এবং সুস্থ হয়ে উঠেছেন। খুব কম সংখ্যক মানুষ মারা গেছেন।
বেশীরভাগ আদিবাসীরাই ঝাড়ফুক/তুকতাকে বিশ্বাসী। বাড়ির কারো অসুখ-বিসুখ হলে ওঝাকে (গুনিন) ডেকে আনা হয় এবং তার দেওয়া তাবিজপড়া, সরিষাপড়া রোগীর হাতে বেঁধে দেওয়া হয়। প্রয়োজনে ওঝা রোগীকে ফু দিয়ে ঝেড়ে দেন। ফলে রোগীটি সুস্থ হয়ে উঠে বলে জানা যায়। এমন কি পাড়ার লোকেরা আপদে-বিপদে না পড়ে, রোগ-ব্যাধিতে না ভোগে ; কলেরা, বসন্তের মত রোগ পাড়ায় না আসে সেইজন্য ওঝা পাড়াটি তন্ত্র-মন্ত্র, জলপড়া, সরিষা পড়া দিয়ে বেঁধে দেন।
অবশ্য স্বল্পসংখ্যক অ-আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এইরূপ ভ্রান্ত ধারণাও কাজ করে থাকে। যেমন করোনা তাড়াতে ধুমধাম করে বট-পাকুড়ের বিয়ের আয়োজন করা হয় ফালাকাটা ব্লকের গুয়াবরনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা হরেকৃষ্ণ মন্ডলের বাড়িতে ১/৭/২১ তারিখে। পুরোহিত দিলীপ মৌলিক মন্ত্রপাঠ করে বট-পাকুড়গাছের বিয়ে সম্পন্ন করেন। নিরামিষ ভোজের ব্যবস্থা ছিল। (উত্তরবঙ্গ সংবাদঃ ২/৭/২১, পাতা - ২)।
অতএব বলা যায় যে, গ্রাম বাংলার অধিকাংশ মানুষের মননে-হৃদয়মূলে অন্ধবিশ্বাস বা ভ্রান্ত ধারণা স্বাধীনমত বাসা বেঁধে আছে যা একেবারে ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক এবং অবিজ্ঞান সম্মত। রোগব্যাধি বা অতিমারী দেখা দিলে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ রোগীকে ডাক্তারের পরামর্শ মত ঔষধ খাওয়াতে হবে ; স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
এমন কি অতিমারী করোনার ক্ষেত্রেও ওঝামতি/ঝাড়ফুকের আশ্রয় না নিয়ে সরকারি নির্দেশিত নিয়ম যেমন মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া এবং ডাক্তারের পরামর্শমত ঔষধ সেবন করা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা — এসব নিয়ম ঠিকমত মানা হলে নিশ্চয় আমরা অতিমারী করোনাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হব।