Writings of Tribal Authors (Bilingual)
আমি খেড়িয়া শবর আদিম বনবাসী, জনজাতি সম্প্রদায়ের মাঝেই আমার জন্ম। নাম — শ্রী জলধর শবর, গ্রাম + ডাক — কুদা, থানা — কেন্দা, জেলা — পুরুলিয়া, পিতা ঁনারান শবর, মাতা ঁঁরুহনবালা শবর। খুবই অভাবের সংসারে এমত অবস্থায় কুদা প্রাইমারী স্কুলে পড়তে যেতাম। সেখানে খুদে গমের ভাঙ্গানো দানা ও মাইলা গুড়ি খেতে দিত। এইভাবে প্রাইমারী স্কুল শেষ করে, মহাড়া স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্ত্তি হই। পরের বৎসর ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্ত্তি হই কুড়ুকতোপা আনন্দদীপ হাই স্কুলে। এরপর রাজনোওয়াগড় ডি. পি. এম. হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্ত্তি হই। এরপর ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই। কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারিনি। পঞ্চাশের দশকে আদিম বনবাসী জনজাতি বসবাসকারী শবরদের বনভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। খেড়িয়া শবররা পুলিশ ও গ্রামবাসীদের কাছেও সুরাহা পায়নি। ঐ সময় তুড়্যব্দ গ্রামের শবর পাড়ার দুইজন শবর রাজনোওয়াগড় হাট থেকে সন্ধ্যেবেলায় ফেরার পথে বিজয়ডি গ্রামের গ্রামবাসীরা বল্লারী শবরকে পাথর দিয়ে হাত, পা ও কোমর ভেঙ্গে দেয়। এরপর তার ছেলে মঙ্গল শবরকে মেরে ফেলে। তাদের অপরাধ নাকি পলাশ জঙ্গল থেকে লাক্ষ্যা চুরি করেছিল।
তাই উদ্যোগী হয়ে, আদিম বনবাসী খেড়িয়া শবর জনজাতির সাজানো অপরাধীর কলঙ্ক চিহ্নকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে ১৯৬৮ সালের ৭ই জানুয়ারী — (১) রাজনোওয়াগড়ের মাস্টারমশাই গোপীবল্লভ সিংহ দেও, (২) হারাধন শবর, ডুমুরডি, (৩) বুধন শবর, ডুমুরডি, (৪) নারান শবর, কুদা, (৫) চুনারাম শবর, কুদা, (৬) নন্দ শবর, কুদা, (৭) শম্ভু শবর, বাবুইজোড়, (৮) শুকু শবর, বালডি, (৯) মদন রায়, দেওরাজ, এঁদের চিন্তায় মানবাজার ব্লকের কুদা গ্রামে প্রথম সভা ডাকা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে শবররা পুলিশের ভয়ে আসতে চায়নি। তাই এরা অত্যাচারিত শবরদের নিয়ে হাজির হয় এবং সংগঠিত হয়। খেড়িয়া শবরদের একতা স্থাপনের চেষ্টা শুরু করা হয়। খেড়িয়া শবরদের ভাবতে শেখানো হয় বাঁচতে হলে একা বাঁচা যায় না। খেড়িয়া শবরদের মানসিক স্তরে একটা আলোড়ন গড়ে তোলা হল। তাঁদের নিষ্ঠা, সততায় বনবাসী খেড়িয়া সমাজ যে জিনিসটা শিখল তা হলো একতা। সেই কাজটা আমাদের বাবা জেঠারা আরম্ভ করেছিলেন। সমস্যার সমাধান করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। গঠিত হয় 'শবর সমিতি'। এঁরা জেলা, ব্লক ও গ্রাম কমিটি গঠন করেন। আদিম বনবাসী শবর সন্তানদের কৃষি জীবনের অভ্যাস এবং নিজস্ব জমি না থাকায় খাদ্যের অভাব ঘটে। পেটের দায়ে কয়েকজন অসামাজিক কাজ করে ফেলে। পুলিশ ও গ্রামবাসীদের অত্যাচারে ও নির্বিচারে শবরদের গ্রেফতার এবং বিনা বিচারে হাজতে বাস করতে হয়। শিক্ষার আলো খেড়িয়া শবরদের জীবনে না পৌঁছানোয় পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটে। খেড়িয়া শবররা কর্মহীন বলে গ্রামের মানুষের চোখে ঘৃণা ও মিথ্যা সন্দেহে পড়ে।
জেলার সকল শবরদের সংঘবদ্ধ করা, উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া বাস্তু পুনরুদ্ধার করা, দখলীকৃত অকৃষিভুক্ত জমিকে কৃষিকাজে উপযুক্ত করে তোলা, সমগ্র শবর সমাজকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা, এই সকল কার্যক্রমগুলিকে শবরদের মধ্যে প্রসার ঘটানোর জন্য জেলার বিভিন্ন প্রান্তে 'ডাল পরব' নামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও নাচগানের অনুষ্ঠান শুরু হয়। কয়েক বৎসরের মধ্যেই শবর সমাজের মধ্যে একটা অগ্রগতির আলোড়ন সৃষ্টি হয়। খেড়িয়া শবরদের জীবনে ১৯৬৮ সাল যেমন স্মরণীয় সাল তেমনি ১৯৮৩ সালের ১২ ই নভেম্বর মালডি (কলডি) শবর মেলাতে কয়েকজন শবর ও মাস্টারমশাই গোপীবল্লভ সিংহ দেও মশাইয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে মালডি গ্রামের 'শবর মেলায়' যোগদানের জন্য মহাশ্বেতা দেবী সম্মতি জানান। মহাশ্বেতা দেবীকে পুরুলিয়া শহর থেকে নিয়ে আসার জন্য দায়িত্ব পড়ে প্রশান্তবাবুর উপর। সেদিন ওই মেলাতে মহাশ্বেতা দেবীকে হাজার তিনেক শবরের উপস্থিতিতে 'শবর মাতা' নামে ঘোষণা করেন উপস্থিত শবররা। সেদিন সমিতির নতুন নামকরণ হল — 'পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি'। সেদিন তেত্রিশজনের কমিটির মধ্যে মহাশ্বেতা দেবী হলেন কার্যকরী সভাপতি। সেদিন তিনি খেড়িয়া শবরদের বলেছিলেন, "তোমরা যখন আমায় মা বলেছ, তখন আমার মৃত্যু পর্যন্ত তোমাদের সুখে দুঃখে সাথে থাকবো। তোমাদেরকেও শপথ নিতে হবে যে, তোমরাও সমিতির কথামত চলবে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবে। বয়স্করাও একটু লেখাপড়া শিখবে, যারা অসামাজিক কাজে লিপ্ত তাদের ওই কাজ ছেড়ে চাষবাসের কাজে যুক্ত হতে হবে। রাস্তাঘাটে মদ খাওয়া চলবে না। শবর মহিলাদের এগিয়ে আসতে হবে।" — তাই শবরেরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে মায়ের কাছে নালিশ করে, মা তাদের রক্ষা করেন, প্রতিপালন করেন, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের কাছে খেড়িয়া শবরদের পক্ষে দরবার করেন, সংবাদপত্রে প্রতিবাদ করেন।
স্বনির্ভরতায় শবর সমাজ ঃ
এরপর খেড়িয়া শবরদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করার জন্য খেড়িয়া শবর সমিতি উদ্যোগ নিয়েছে। কিচেন গার্ডেন প্রকল্প ২০২০ সালের ১লা আগস্ট থেকে শুরু হয়েছিল। ৭৩৮ জন পরিবার স্বেচ্ছায় এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করে। এই কাজে দুইজন কৃষিবিদ নিয়োগ করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে চাষের অভিজ্ঞতা আছে এমন ১৫জন কর্মীকে এই প্রকল্পে সমিতি যোগদান করায়। যেমন — বেগুন, টমেটো, লঙ্কা, ভেন্ডী, বীন, সিম, বরবটী, বাঁধাকপি, ফুলকপি, পাঁকচুই, পিয়াঁজ, রসুন, ধনে, পালং শাক, গাজর ইত্যাদি ফলানো হয়। এছাড়া প্রত্যেক শবর বাড়ীতে কোন না কোন ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। যেমন, আম, বারোমাসের সজনে, পেঁপে ও বাঁশচারা ইত্যাদি গাছের চারা প্রদান করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলির ১৫টি ক্লাস্টারে ৬৮-টি গ্রামে কিচেনগার্ডেন প্রজেক্টের সাফল্যের পেছনে সকল সি.আর.পি মেম্বার ও কৃষিবিদ সুদীপ্ত সৎপতির নিরলস পরিশ্রম রয়েছে। এঁরা দিনরাত মাঠে ঘাটে খেটেছেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শবর পাড়াগুলোতে দৌড়ঝাঁপ করেছেন। জৈব সারের যোগান দেওয়া ও বীজ চারা বিতরণ করা, ১৫-টি ক্লাস্টারে ১৫-টি পাম্প জলের ব্যবস্থা করা, এসব শুধু ধন্যবাদ দিয়ে হয় না, আরও বড় কিছু এঁদের প্রাপ্য।
মেম্বারসিপ টার্গেট ছিল ২০০ জনের। সেখানে ৫৮২ জন পরিবার সদস্য। সংগ্রহ টার্গেট ছিল ১০,০০০.০০ টাকা। সমিতি সংগ্রহ করতে পেরেছে ২৯,৩৫০.০০ টাকা।
ইউথ ক্যাম্প ঃ ১৪ টি গ্রাম থেকে মহিলা ২৫ জন, পুরুষ ১০ জন, মোট ৩৫ জন। আলোচ্য বিষয় — মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, চাষবাস সম্বন্ধে আলোচনা, পড়াশুনা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা।
ফরেন্ট রাইটস অ্যাক্ট — ৪১ টি গ্রামে ৪৭৩ টি ফর্ম পূরণ করে জমা নেওয়া হয়েছে।
রেশন কার্ড — ১২৯ টি গ্রামে ৬২৯ জনের ফর্ম পূরণ করে জমা করা হয়েছে, কিছু কিছু রেশন কার্ড দিতে শুরু করা হয়েছে।
আধার কার্ড — ১২৯ টি গ্রামে ৮৫৭ জনের ফর্ম পূরণ করে ডি. এম. সাহেবকে অনুরোধ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসাথী কার্ড — ১০০ টি গ্রামে ৫০৮ টি ফর্ম পূরণ করা হয়েছে। অনেকেই স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পেয়েছে।
বিধবা পেনশন — ১৫ টি গ্রামে ২২ টি ফর্ম পূরণ করে জমা করা হয়েছে।
কাস্ট সার্টিফিকেট — ১০০ টি গ্রামে ৬০৯ টি ফর্ম পূরণ করে জমা করা হয়েছে।
বিকলাঙ্গ কার্ড — ১৯ টি গ্রামে ৩৮ জন শবর উপকৃত হয়েছে এবং ১,০০০.০০ করে পাচ্ছে।
জব কার্ড — ৪ টি গ্রামে ৪০ জনের জন্য দরখাস্ত করা হয়েছে।
ফিসারমেন কার্ড — ৩ টি গ্রামে ৩৮ জনের ফর্ম পূরণ করা হয়েছে, সকলেই কার্ড পেয়েছে।
নতুন পাশবই খোলার জন্য ১০ টি গ্রামে ১১৯ জনের অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে।
ভোটার পরিচয় পত্র — ২ টি গ্রামে ২০ জনকে দেওয়া হয়েছে।
সি.এল.সি. স্কুলে খেলার সামগ্রী দিলে পড়াশুনায় ছেলেমেয়েরা আরও আগ্রহী হয়, এটা আমরা শিখতে পেরেছি। বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব করে পড়াশুনা করালে ওরা আগ্রহের সহিত স্কুলে আসে, তাই সমিতি থেকে ১৪ টি সি.এল.সি চলছে। মাইগ্রেসেনের জন্য বাচ্চারা স্কুল থেকে বঞ্চিত হয়।
কোন ডকুমেন্ট শবরদের হারিয়ে গেলে তাদের নতুন করে দরখাস্ত লিখে দেওয়ার মত শিক্ষিত লোক গ্রামে নেই। তাই সমিতির কর্মীদের খোঁজ নিয়ে সেগুলি আবেদন করাতে হয়। গ্রামের কোন লোকই শবরদের এই সহযোগিতা করে না। শবর সমিতি ছাড়া গ্রামের লোকেরা শবরদের এখনও সহযোগিতা করে না। এ কারণেই শবররা অনেক পিছিয়ে এবং যার ফলে শবররা সরকারী সুযোগ সুবিধা বেশি পায় না।
আইনি সহায়তা — যে কোন শবর পাড়ায় শবরদের উপর যদি কিছু ঝামেলা বা অসুবিধা হয়ে থাকে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সমিতিকে জানালে সমিতির কোন প্রতিনিধি দু-তিন ঘন্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হবেন এবং গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হবেন। এছাড়া সমস্ত আদালত সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমার ক্ষেত্রেও শবররা সমিতির উপর নির্ভরশীল।
স্বাস্থ্য — শবররা টাকার অভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিতে আগ্রহী নয়। সমিতি মনে করে যে, শবরপাড়া থেকে হাসপাতাল অনেক দূরে থাকার জন্য ওরা যেতে চায় না। সেক্ষেত্রে শবরপাড়াতে স্বাস্থ্যশিবির বা ক্যাম্প করলে সকলেই চিকিৎসা করতে উৎসাহী হবে।
তাই মাননীয়া ডাঃ সঙ্গীতা নায়ার রাণিবাঁধ বাঁকুড়া শবরপাড়া পরিদর্শন ও ক্যাম্প করে কম টাকায় ঔষধ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
কোভিড-এর সময় নেটওয়ার্কের জন্য কিছু সমস্যা হয়েছিল, বাংলাতে লেখালেখি হয়েছে, হিন্দি ও ইংরেজী খুব বেশি একটা জানা নেই। কারণ বেশীরভাগ ছেলেরা বেশী বেতনের জন্য ভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে যায়।
শবর ভাষায় করোনা নিয়ে গীত — ২০২০ সাড়
করোনা ভাইরাস নিখ্যাঁডিয়া শবর সবাইকে শুড়্যাতনু।
(১) নভেল করোনা ভাইরাস নি, অত ডরাত হেবাক নাই, অত ডরাই কিস হামর হেবাক।
রং — নিয়ম গা সোব মানি গেনেয় নাই ভাইরাস হেবাক।
অত ডরাই কিস হামর হেবাক।।
(২) পশ্চিমবঙ্গর বাহিরর হুঁ কেউ কাজ কুরি আনে, চৌদ্দ দিন ঘরর বাহিরে নিকড়িত দিবার নাই, একটা ঘরে এক নাই রুহিত হেবাক।।
(৩) যদি ওরা পে নিকড়য়, তাহনে কাঁহর পাশক যাবার নায়, ধুরর হুঁ রাজট কুরিত হেবাক।।
(৪) বাহিরর হুঁ আসার পরেই, আঁশা দিদিক জ্যাঁড়াত হেবাক, মুই আনু বাহিরর হুঁ, ভাইরাস, চেক করাত হেবাক।।
(৫) নিজর পিঁন্ধা ডেঙপা বা বিছনা পর্ত্রর, কাকৈউ ছুইত
দিবার নাই সবধান হি সবাইকে রুহিত হেবাক।।
(৬) পাঁইড় নাগা জ্বর নিঃশ্বাস কষ্ট হেনে সরকারী ডাক্তারক
দেকাত হেবাক, ছেঁকা খাঁগা হেনে টুন্ডে, উরমাল ঢাঁকা নি ছিঁকিত হেবাক
(৭) রগট হাথে টুঁন্ডে আঁখে, হাত তুম দিয়ানা, সাবন দি হাত ধুই নিবা, তারপরে টঁন্ড পুইছিবা না।।
(৮) সত খঁড়ে খাওয়ার আগুই, সাবন দিকচ্ছ কুইরি,
হাত ধুই নিবা, জলধর বর্ণয় , সুখে রহ ভন রহ, নিয়ম
গা সোব মানি চন, সমিতির হুঁ সবাইকে তাই জাঁগড়াতনু।।
মহর পে শুরু বেটা ছাউ, ও বিটি ছাউগাঁকভন বাসা জঁগড়াতনু।।
মহর লে বডগাঁক-গড় বা ডন্ডবত কুরিতনু।।