রোগের কারণ

বর্তমানে বিশেষ করে উচ্চ এবং শিক্ষিত সমাজে অনেক লোক মধুমেহ বা ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। একথা ঠিক যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অত্যধিক উন্নতির কারণ মানুষের আয়ু বেড়ে গেছে এবং প্রতিটি মানুষ সাবধান হয়ে গেছে। অপরদিকে এই মধুমেহ রোগ বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। এর কারণ হলো জন্মকালীন শিশুরা ইনসুলিনের জন্য জীবিত থাকে। মেদবৃদ্ধির সঙ্গেও এই রোগের সম্বন্ধ আছে। উচ্চ সমাজে প্রতি ৫ জন ব্যক্তির মধ্যে একজন বেশী ওজনের হবার ফলে মধুমেহ রোগে আক্রান্ত হয়। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, চিকিৎসা করার পরেও এবং এই রোগের কারণ জানার পরেও, এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে, এমন অধিক লোকের সংবাদ পাওয়া. যাচ্ছে।
সারা বিশ্বে শতকরা দু'জন লোক এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং সর্বদা এই রোগের চিকিৎসায় নিযুক্ত আছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বৃটেনে বর্তমান সময়ে পাঁচ লাখের অধিক লোক আর আমেরিকায় ত্রিশ লাখেরও অধিক লোক এই রোগে পীড়িত হয়েছে। এদের মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যাদের রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা করে দেখলে জানা যাবে মধুমেহ হবার কি কারণ।
এই রোগে আক্রান্ত অর্ধেক রোগীর বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাট্ বৎসর। দশ বছর বয়সের নিম্ন বয়স্ক রোগী মাত্র শতকরা পাঁচজন। আশি বছর বয়স্ক রোগী শতকরা তিনজন। বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা খুব তফাৎ নয়। যদিও আমেরিকানদের মধ্যে ইহুদীদের এই রোগীর সংখ্যা কিছু বেশী; কিন্তু ইস্রাইলে তা নয়, নারী এবং পুরুষের মধ্যে এই রোগীর সংখ্যার মধ্যে খুব বেশী তফাৎ দেখা যায় না। এই তথ্য পাওয়া যায় উত্তর ইউরোপ এবং ইউনাইটেড স্টেটস দ্বারা সাংখিক গণনার দ্বারা। এই রোগাক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শুধুমাত্র তফাৎ হলো—অল্পবয়স্ক ছেলেদের এই রোগ হবার বেশী সম্ভাবনা থাকে আর প্রৌঢ়াবস্থায় পুরুষের চেয়ে মহিলাদের মধ্যে অধিক রোগী পাবার সম্ভাবনা থাকে। 
বংশগত কারণ—এই রোগের মধ্যে বংশগত কারণ একটি প্রধান ভূমিকা গঠন করে। আবার অনেক সময় এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। কাজেই এদিক থেকে একে জটিল কারণ বলা যায়। একটা বিষয় দেখা যায় যে, বংশ পরম্পরা দ্বারা পীড়িত ব্যক্তির সব শিশুদের এই রোগ হয় না। যদিও এই রোগগ্রস্ত ব্যক্তির শিশুদের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে, তবুও অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়।
স্থূলতা—অধিক মোটা বা ওজন যাদের বেশী। বিশেষতঃ প্রৌঢ় মহিলাদের এই রোগ হবার সম্ভাবনা খুব বেশী থাকে। যাদের তিন-চারটি সন্তান হবার পর দেহের ওজন বেড়ে যায়, তাদের এই রোগ হবার ভয় থাকে। দেহ অধিক ভার হওয়া অথবা মোটা হওয়া, আকার প্রকারে লম্বা চওড়া হওয়া প্রভৃতি থেকে জানা যায় যে কার্বোহাইড্রেট্স অথবা শর্করা তারা খায়, সেই শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট্স তাদের দেহের উপযোগী হয় না। যখন এরূপ পরিস্থিতি অধিক বেড়ে যায়, অর্থাৎ অধিক শর্করা দেহে জমে যায়, তখন তাকে এই রোগ আক্রমণ করে।
অধিক আহার—অধিক আহারের ফলে অগ্ন্যাশয়ের ওপর বেশী চাপ পড়ে। তার ফলে অগ্ন্যাশয়কে ক্রমে ক্রমে অকেজো করে তোলে। যে ব্যক্তি অধিক মোটা হয়েছেন অথবা অধিক আহার করেন, এই সব লোকের বংশ পরম্পরায় মধুমেহ রোগের সম্ভাবনা বেশী থাকে। খাদ্য নিয়ন্ত্রণের দ্বারাও এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই সঙ্গে রক্তেও শর্করা কমানো যায়। আহার নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত করলেই প্রস্রাবে শর্করা কমে যায় বা এশোরে কমে যায়। এই দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে খাদ্য এবং স্থূলকায়ত্ব এই দুটি কারণ পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত।
বিষাণু (virus) সংক্রমণ—মধুমেহ বা ডায়াবেটিস রোগে বিষাণু সংক্রমণও দোষী বলা যায়। বর্তমানে এই বিষয়ে বহু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে যে, কোন প্রকারে এই রোগের বীজাণু সংক্রমণ হলেই সামান্য সর্দি-কাশি দেখা দেয়, রোগীকে এই রোগ আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা যায়। একথা আজ সকলেই জানতে পেরেছেন যে, বীজাণু সংক্রমণের ফলে শরীরে এক প্রকার চাপ সৃষ্টি হয়। রোগ আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
যদি কেউ প্রশ্ন করেন বীজাণু আক্রমণই কি এই রোগের প্রধান কারণ? তার উত্তর আজও কেউ দিতে পারেননি। তবে একথা ঠিক যে, এই রোগ সংক্রামক নয়। এই রোগ পরিবারবর্গের মধ্যে বা জনসংখ্যার মধ্যে আনুবংশিক সম্ভাবনার চেয়ে বেশি বিস্তার করে না। কিছু লোকের মধ্যে মধুমেহ সৃষ্টিকারক কোন জীবাণু প্রবেশ করে খুব তাড়াতাড়ি শ্বেত রক্তকণিকা থেকে উৎপন্ন প্রোটিন অর্থাৎ যেটা রোগ প্রতিরোধক শক্তি, সেটিকে নষ্ট করে দেয়। আবার যাদের শরীরে গোড়া থেকেই রোগ প্রতিরোধক শক্তির অভাব থাকে, তাদের দেহে এই রোগ সহজেই উৎপন্ন হয়। এই বিষয় নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলছে। আজও সফলতা লাভ করা যায়নি। কিন্তু
বর্তমানে জানা গেছে যে, শরীরে কোনও রোগ হলে বা দীর্ঘদিন রোগে ভুগে শরীর দুর্বল ইত্যাদি হলে, এই রোগ আক্রমণ করতে পারে।
অধিক চিন্তা-ভাবনা বেশী চিন্তা-ভাবনার কারণ স্নায়ুতন্ত্রে চাপ সৃষ্টি হয়। তার ফলেও এই রোগের সম্ভাবনা থাকে। অনেক রোগীকে পরীক্ষা করে এই রোগাক্রান্ত বলে, নির্ধারণ করার পর, তার কাছে কারণাদি বিষয়ে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ সময় তাকে নানা রকম ভাবনা-চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়। এর ফলে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, বেশী চিন্তা ভাবনার জন্যই তাকে এই রোগ আক্রমণ করেছে।
অধিক চিন্তা-ভাবনার ফলে এ্যাড্রিনালিন ও কর্টিজোন (Adrenalin & Cortisone) অর্থাৎ যাতে চিন্তাশীলতার হরমোন বলে, সেই হরমোন অধিক খরচ হওয়ার ফলে কিছুদিন পর এই রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া যে রোগীকে অপর কোনও রোগের চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ দিন কর্টিজোন দেওয়া হয়, তারও এই রোগ হয়ে যায়। অতএব বলা যায় যে, হরমোনের অভাবে এই রোগ হয়, আবার সেই হরমোনের বৃদ্ধিতেও এই রোগ হয়।
যাই হোক, বাস্তবিক কারণ এবং তার প্রভাব ও তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধ এখনও স্পষ্টভাবে জানা যায় নি। সর্বাধিক এইটুকু বলা যায় যে, এই রোগের কারণ এবং পরিণাম সম্পর্কে কিছু পারস্পরিক সম্বন্ধ আছে। সহজ কথায় যার স্বল্পতায় এই রোগ হয়, তার বৃদ্ধিতেও এই রোগে হয়ে থাকে।
গ্রন্থি সম্পর্কিত ব্যাধি ইনসুলিন যেমন অগ্ন্যাশয়ের একটি প্রধান হরমোন, সেই রকম আবার যদি অন্য হরমোন উৎপন্নকারী গ্রন্থিতে কোনও গোলমাল দেখা দেয় তাহলে মধুমেহ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। মস্তিষ্কের নিম্নভাগে অবস্থিত পীযূষ গ্রন্থি যাকে ইংরাজীতে পিটুইটারী গ্রন্থি (Pituitary gland) বলে। এটি অনেক প্রকার হরমোন উৎপন্ন করে, এবং এর দ্বারা অনেক শারীরিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়। এই হরমোনগুলির মধ্যে একটি এমন হরমোন আছে, যেটি মানবদেহের বিশেষ প্রয়োজনীয় হরমোন। এটি বিশেষ করে শৈশব্যবস্থা ও যুবাবস্থায় অধিক গতিশীল থাকে। শিশু অবস্থায় মধুমেহ সেই সময়েই বেশী হয়, যখন তার বৃদ্ধি বেশী হতে থাকে। শতকরা ৮০ জন শিশুর এই রোগে আক্রমণের সময় হলো যখন তার বয়স অনুপাতে বেশী লম্বা হয়ে যায়। এই হরমোনের ক্রিয়ার ফলেই গর্ভবতী নারীর শিশুর আকার বৃদ্ধি হয়।
এইভাবে দেহ অধিক বৃদ্ধির ফলে হরমোন বেশী খরচ হয়, ফলে অগ্ন্যাশয়ের শক্তি খুব বেড়ে যায়, আবার অনেক ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের শক্তি পূর্বাপেক্ষা কমে যায়। নিশ্চিতভাবেই জানা গেছে যে অগ্ন্যাশয় ও তাতে উৎপন্ন ইনসুলিন খরচ হবার অব্যবস্থার ফলে মধুমেহ আক্রমণ করে। ইনসুলিন অগ্ন্যাশয়ের বিশিষ্ট কোষ (Cell) সমূহ থেকে পাওয়া যায়। যাকে ল্যাঙ্গারহ্যান্স আইলেট্স বলা হয়। এই ইনসুলিন সাধারণতঃ রক্তে শর্করা স্তরকে নিয়ন্ত্রিত করে।
যে সুস্থ ব্যক্তিদের আট ঘণ্টা পর্যন্ত শর্করা প্রয়োগ না করা হয়, তাদের শর্করা স্তর ৬০ থেকে ৯০ মিলিগ্রাম প্রতি শত মিলিমিটারে থাকে। এটি এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ। একে ফাস্টিং ব্লাড সুগার বলা হয়, অর্থাৎ রোগীকে ১২ ঘণ্টা কিছু খেতে না দিয়ে তারপর তার রক্তে শর্করার পরীক্ষা করতে হয়। খাদ্য গ্রহণ করার পর রক্তে শর্করা বৃদ্ধি পায়। খাদ্য গ্রহণের ২।১ ঘণ্টা বাদ অগ্ন্যাশয় দ্বারা ইনসুলিন খরচ হতে থাকে।
মধুমেহ রোগগ্রস্ত রোগীর এই স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া ঠিকমত হয় না। কেন এটি হয়, তা বুঝবার জন্য মানবদেহে শর্করার উপযোগ বিধি জানতে হবে।