আজ থেকে অনেক দিন আগে এমন অবস্থা ছিল যে, তখন মধুমেহ বা ডায়াবেটিস রোগকে একটা ভয়ঙ্কর এবং মৃত্যুতুল্য ব্যাধি মনে করা হতো। সে সময় এই রোগ হলে সকলেই তার জীবনের আশা পরিত্যাগ করতো।
আজও এই রোগ লক্ষ লক্ষ মানুষের হচ্ছে, কিন্তু আজ এই রোগকে ঔষধ এবং খাদ্য নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তন দ্বারা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। মনোযোগ সহকারে আহারের সামান্য পরিবর্তন এবং সেই সঙ্গে এক-আধটা ট্যাবলেট অথবা ইনসুলিন (Insulin) নামক হরমোন ইঞ্জেকশানের দ্বারা যে কোনও মধুমেহ অর্থাৎ ডায়াবেটিস রোগী সাধারণ এবং সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন। এর বেশী আর কিছু করবার দরকার হয় না এই রোগীর।
'এই রোগ আক্রমণ করলে শরীর নড়বড়ে হয়ে যায়। আর কোন না কোনও রূপে এর দ্বারা দেহের সারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রোগ প্রভাব বিস্তার করে। এই রোগ আক্রমণ করছে ' বুঝতে পারলেই রোগী এবং রোগীর পরিবারবর্গের সকলে, অর্থাৎ যারা রোগীর সঙ্গে সর্বদা একত্রে থাকেন তাঁরা রোগীর খাদ্য, ব্যায়াম এবং বিভিন্ন পরীক্ষাদির বিষয়ে জানবার চেষ্টা করবেন। রোগীকে কোন্ সময় কোন্ খাদ্য খেতে দিতে হবে সে সম্বন্ধে জানা না থাকলে, রোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
রোগীকে প্রতিদিন রোগ প্রতিরোধক ট্যাবলেট বা ইঞ্জেকশান দেওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হয়, আর সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে মূত্র পরীক্ষা করাতে হয়। এইভাবে একটা নিয়মের মধ্যে যদি রোগীকে রাখা যায় বা তার শুশ্রূষা করা যায়, তাহলে রোগীর স্বাস্থ্য ঠিক থাকে।
মধুমেহ বা ডায়াবেটিস রোগ আক্রমণ করলে রোগীর দেহস্থ কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrate) নামক শক্তিদায়ক খাদ্য দেহে কোনও কাজ করে না, বা কোনও কাজে আসে না। অর্থাৎ এই রোগে শরীর উক্ত খাদ্য বিষয়ে কোনও সুবিধা করতে পারে না। অর্থাৎ অযোগ্য হয়ে পড়ে।
কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrate) নামক পদার্থটি আমাদের পাচক সংস্থান দ্বারা শর্করায় পরিবর্তিত হয়; কিন্তু এই রোগ আক্রমণ করলে দেহস্থ শর্করা রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে এবং প্রস্রাবের সঙ্গে দেহ থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় এই শর্করা আমাদের দেহে এক শক্তিদায়ক তত্ত্বরূপে কাজ করে, এবং চর্বিরূপে দেহে একত্র হয়ে থাকে।
কিন্তু এই রোগ আক্রমণ করলে শর্করা দেহের কোনও কাজে আসে না। তখন এই শর্করা প্রস্রাবের সঙ্গে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। এজন্যই একে বলা হয় ডায়াবেটিস রোগ। ডায়াবেটিস শব্দটি গ্রীক ভাষা। এর অর্থ হলো—বাইরে বেরিয়ে যাওয়া বা প্রবাহিত হওয়া। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেখা যায় যে, এই রোগটি হাজার বছর পূর্বেই ধরা পড়েছিল। সেই সময় গ্রীক চিকিৎসকগণ এই রোগটিকে দেহনাশক বলেছিলেন।
কারণ তাঁরা দেখিছিলেন এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দেহের ওজন ভয়ঙ্কর ভাবে কমে যায়।
মধ্যযুগে ইউরোপের চিকিৎসকগণ এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির প্রস্রাবে শর্করা (Sugar) আবিষ্কার করেন এবং ল্যাটিন ভাষায় এর নামকরণ হয় (Mellitus) মেলাইটাস। এর অর্থ হলো শর্করা যুক্ত প্রস্রাব। আজও একে শর্করামেহ (Diabetes mellitus) ডায়াবেটিস মেলাইটাস বলা হয়।
এই রোগ বা অব্যবস্থা শরীরে কেন হয়। এর জন্য গবেষণা চলতে থাকে। শেষে এর কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বুঝতে পারা যায়। বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন গবেষণার দ্বারা এই রোগের কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে মাইক্রোস্কোপ (Microscope)- এর সাহায্যে ছোট ছোট ব্যাকটিরিয়া (Bactiria) বা কীটাণু ধরা পড়ে এবং বৈজ্ঞানিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানব দেহে এইসব ব্যাকটিরিয়ায় কি কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তারও অনুসন্ধান চলতে থাকে।
১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে পশুদের উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, পাচক অঙ্গের প্যাংক্রিয়াস নামক গ্রন্থি (Pancreas glands)-টি যদি কেটে বাদ দেওয়া যায়, তাহলে ওই পশুতে মধুমেহ রোগের সব চিহ্ন এবং লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। এই প্যাংক্রিয়াস গ্রন্থিটিকে ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে অগ্ন্যাশয় বলা হয়। এটি পেটের ওপরের দিকে থাকে। আমাশয়ের ঠিক নিচেই এর অবস্থান। এটি লম্বায় ৬ থেকে ৯ ইঞ্চি অর্থাৎ বর্তমান মাপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার। চওড়ায় ২ থেকে ৩ ইঞ্চি, বর্তমান মাপ অনুযায়ী ৫ থেকে ৮ সেণ্টিমিটার।
প্যাংক্ৰিয়াস গ্রন্থিতে ছোট ছোট রক্তবাহী নালিকার জাল থাকে, আর এই রক্ত নালিকাগুলি একটি বড় নালীতে পরিবর্তিত হয়ে অস্ত্রের প্রথম ভাগে ফেলা হয়। এর নাম হলো ডিওডিনাম (Deodenum)। ভিক্টোরিয়া যুগের শেষ ভাগ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকগণ পরীক্ষার দ্বারা জানতে পারেন নি যে অগ্ন্যাশয় (Pancreas) গ্রন্থিটির কাজ কি। তাঁরা একে একটা গ্রন্থি (glands) বলেই জানতেন। এর বেশী আর কিছু নয়। তাঁরা এটুকুই জানতেন যে, এর দ্বারা পাচক যন্ত্রে রক্ত প্রবাহিত হয়।
১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রেডারিক বেটিং নামে একজন ক্যানাডিয়ান সার্জন এবং চার্লস বেস্ট নামে একজন ডাক্তারী বিদ্যার ছাত্র টোরন্টো অনুসন্ধানশালাতে পরীক্ষা দ্বারা আবিষ্কার করেন যে, অগ্ন্যাশয় গ্রন্থির একটা অশে থেকে এক প্রকার রস নিঃসৃত হয়। সেই রস থেকে ইঞ্জেকশান তৈরী করে মধুমেহ রোগগ্রস্ত ব্যক্তির দেহে ইঞ্জেকশান করা যায়, তাহলে এই রোগ আরোগ্য হয়।
অগ্ন্যাশয় থেকে যে রস তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন, তার নাম রেখেছিলেন ইনসুলিন (Insulin)। কারণ এটি ল্যাঙ্গারহ্যান্স আইলেটস (Ilets of Langerhans) থেকে বেরোয়। ল্যাঙ্গারহ্যান্স আইলেটস্ বিশেষ কতকগুলি কোশিকা। যেগুলি অগ্ন্যাশয়-এর স্পঞ্জ গ্রন্থি ( Spang glands) থেকে বেরোয়।
ইনসুলিন হলো একপ্রকার হরমোন। এটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়ে রক্ত নালিকার দ্বারা মানরদেহের অন্যান্য অংশে পৌঁছে ক্রিয়া-শক্তি উৎপন্ন করে। ইনসুলিন আবিষ্কার হবার পর সকলেরই ধারণা হয় যে, মধুমেহ সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।
মধুমেহ রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের অগ্ন্যাশয় দ্বারা পর্যাপ্ত মাত্রায় ইনসুলিন উৎপাদন হয় না। যার ফলে এই রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের আহার্য দ্রব্যের সাথে গ্রহণ করা শর্করা হজম হয় না, বা পরিপাক করা যায় না। তার ফলে দেহে শর্করা অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সেই শুধুমাত্র এইটুকুই বুঝতে পারা যায়, কিন্তু ইনসুলিনের স্বল্পতার সঙ্গে এই রোগের কি সম্বন্ধ তা জানা যায় না।
এরপর যতদিন যেতে থাকে ততই মানব শরীরের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার জটিলতার বিষয় অধিক জানতে পারা যায়। আরও জানতে পারা যায় যে, যার দ্বারা এই রোগ সৃষ্টি হয়, তাতেই এই রোগ উপশম হয়।
যাই হোক, ইনসুলিনের দ্বারা এই রোগীর কিছু স্বাস্থ্য লাভও হয় এবং রোগও বেশী বাড়তে পারে না। রোগী স্বাভাবিক থাকে। কিছু অন্যান্য ঔষধও আছে। যেগুলি ট্যাবলেট আকারে বাজারে পাওয়া যায়। যার দ্বারা রক্তে শর্করা কমে আসতে থাকে। এই সঙ্গে অগ্ন্যাশয়কে উত্তেজিত করে বেশী পরিমাণে ইনসুলিন তৈরী করে। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সের রোগীদের জন্য এই সব ঔষধ খুবই উপকারী।