জীবনী

    সরকারী কর্মচারী হিসাবে যাঁরা সাহস, কষ্টসহিষ্ণুতা ও একনিষ্ঠ কর্তব্যপরায়ণতার পরিচয় দেন আমাদের দেশে তাঁদের যথোচিত সমাদর জনসাধারণের মধ্যে হ'তে দেখা যায় না। তাই বলে যবনিকার অন্তরালে থেকে এইরূপ দু' একজন সরকারী কর্মচারী আমাদের জাতীয় জীবনগঠনে যে-টুকু সাহায্য করেন সেটুকুও যদি আমরা অস্বীকার করি, তাহলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটা বিশিষ্ট অংশ চিরদিনই অন্ধকারে থেকে যাবে। অনেকদিন পরে ভারতীয় টেলিগ্ৰাফের অন্যতম প্রাণ-প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় রায় বাহাদুর শিবচন্দ্র নন্দীর কথা ভাবলে আজ সর্বাগ্ৰে ঠিক এই কথাটাই মনে পড়ে। সারা জীবন কাজের মধ্য দিয়ে যে প্রতিভা ও দৃঢ়তা তিনি দেখিয়ে গেছেন বাহিরে তার কোন‌ই পরিচয় হ'ল না; সরকারী দপ্তরখানার ধুলিরাশির মধ্যে তাঁর জীবনের ইতিহাসখানি লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়েই রহিল। আমাদের জাতির দিক থেকে কোন সন্ধান কেউ নিলে না, কতখানি গৌরব করবার মত বস্তু তিনি একদিন আমাদের জাতীয় জীবনে দান করে গেছেন।

   ট্রেণে ক'রে যেতে যেতে জানলার ভিতর দিয়ে যে টেলিগ্ৰাফের তারগুলিকে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলতে দেখা যায়,আজ থেকে প্রায় ৮০।৯০ বৎসর পূর্বে শিবচন্দ্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন কর্মচারী ও শ্রমিকের সাহায্য সেই টেলিগ্ৰাফের যোগসূত্র ভারতের একপ্রান্তকে অন্য প্রান্তের সঙ্গে গেঁথে গিয়েছিলেন।ভারতে টেলিগ্ৰাফের প্রবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে শিবচন্দ্রের জীবনের ইতিহাস এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে যে,একটাকে বাদ দিয়ে আর একটাকে সম্পূর্ণরূপে জানবার উপায় নেই। তাই শিবচন্দ্রের পরিচয় দেবার আগে টেলিগ্ৰাফের জন্মকথা সম্বন্ধে দু' একটি কথা জানা দরকার।

   ১৮২৪ খৃষ্টাব্দে জুন মাসে কলিকাতা সফরে শিবচন্দ্রের যখন জন্ম হয়,তখন এই কলিকাতাকেই কেন্দ্র ক'রে নানা ঝড়-ঝাপ্ টা ও যুদ্ধ বিগ্ৰহের মধ্য দিয়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নূতন রাজ্যের পাকা বনিয়াদ গ'ড়ে উঠেছিল ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের ভগ্নস্তুপের উপর দিয়ে।ইয়োরোপে প্রায় সেই সময় থেকেই বৈজ্ঞানিক অভিযানের যুগ আরম্ভ হ'য়েছে। প্রতিদিন নূতন নূতন আবিষ্কারে ইয়োরোপের পন্ডিতমন্ডলী সারা জগৎকে স্তম্ভিত ক'রে দিচ্ছিলেন।আর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সেই সমস্ত নব নব আবিষ্কারকে ভারতে প্রচলিত করে এই বিশাল ভারতে তাদের শাসন-ব্যবস্থা আরও সহজসাধ্য ক'রে তুলছিলেন।লর্ড ডাল্ হাউসী যখন বহু বাধা-বিপত্তির মধ্যে দিয়েও একটা অদম্য সঙ্কল্পের বলে ভারতবর্ষে টেলিগ্ৰাফের প্রবর্তন করেন তখন তাঁর‌ও লক্ষ্য ছিল শুধু ঐ এক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্থিক রাষ্ট্রীয় উন্নতি বিধান ।

 ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে এসিয়াটিক সোসাইটি অব্  বেঙ্গল সভায় মিস্টার এম্ এড্ লফ‌্ বেজিন একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন । প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল– "অপরিচালক পদার্থের বেষ্টনীর দ্বারা ত্রিশটী প্রবাহক  তারের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহের সাহায্যে এক স্থান থেকে স্থানান্তরে বার্তাবহন।‌" প্রবন্ধকার তার এই বিজ্ঞানীর তত্ত্বটিকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন বটে কিন্তু কিভাবে এটিকে সাধারণের কাজে লাগান যায় তা বোঝাতে পারেন নি। তার জন্য অনেকে তাঁর লেখার বিরুদ্ধে সমালোচনা ক'রে ছিলেন । কিন্তু এই প্রবন্ধটির ব্যবহারিক মূল্য কিছু না থাকলেও একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মূল্য আছে । এই প্রবন্ধটিই  প্রথম টেলিগ্রাফ সম্বন্ধে ভারতবাসীর ঔৎসুক‍্য জাগিয়ে তোলে। এইপ্রবন্ধপাঠের কিছুদিন পরে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের তদানীন্তন রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ডঃ উইলিয়াম্ ‍ব্রুক্ ওসনেসী এম্ ডি ( Dr. William Brooke O' ShaughnesseyM. D.) ব্যবহারিক টেলিগ্রাফী সম্বন্ধে আর একটি প্রবন্ধ লেখেন । তাঁর প্রবন্ধের বিষয় বস্তু ছিল–"প্রবর্তনের দ্বারা উৎপাদিত বৈদ্যুতিক প্রবাহের সাহায্যে টেলিগ্রাফের নির্দেশ-বহন সম্বন্ধে পরীক্ষা ও তাহার সংক্ষিপ্ত পরিচয়।" এ প্রবন্ধ প্রকাশিত হ'বার পর তদানীন্তন রাজপুরুষদের দৃষ্টি ডা: ওসনেসী সাহেবের উপর পড়ল । তিনি তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে ভারতে টেলিগ্রাফের প্রচলন  মোটেই  সাধ্যাতীত নয় । এগার বৎসর পরে ১৮৫০খৃষ্টাব্দে  লর্ড ডালহাউসী যখন  সকল বাধা বিঘ্ন ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও ভারতে টেলিগ্রাফের প্রচলনের জন্য একটা দৃঢ় সিদ্ধান্তে   উপনীত হ'লেন তখন তাঁর প্রথম দৃষ্টি পড়ল ডা:ওসনেসী সাহেবের উপর । তাঁরই উপর বড়লাট বাহাদুর ভারতে টেলিগ্রাফ প্রচলনের   সমস্ত ভার  অর্পণ করলেন । ডঃ ওসনেসী  এই বিষয়ে শিবচন্দ্র নন্দী নামে একজন ভারতীয় কে আপনার প্রধান সহকর্মী রূপে গ্রহণ ক'রলেন । শিবচন্দ্র তখন কলিকাতার টাঁকশালে  একটি সামান্য কেরাণীর কাজ নিয়ে জীবন আরম্ভ ক'রেছেন কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাটের জীবন তিনি কোনদিনই ভালবাসতেন না ; দুঃসাহস তিনি চাইতেন, আর তার একটা খুব সুযোগও জুটে গেল । নানা কারণে ডঃ ওসনেসী একজন ভারতীয়কে আপনার প্রধান সহকর্মিরূপে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তিনি যাঁদের যাঁদের কাছে এই প্রস্তাব করেছিলেন তাঁরা কেউ এই বিপদসঙ্কুল অনিশ্চয়তার মধ্যে আসতে রাজি হ'লেন না । একমাত্র যুবক শিবচন্দ্রই  তাঁর প্রস্তাবে রাজি  হ'য়ে ‌   একটা  বিপদ্সঙ্কুল কর্মপন্থার  মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । শিবচন্দ্রের বয়স তখন মাত্র ছাব্বিশ বৎসর । সেইদিন থেকে ৬০ বৎসর বয়সে অবসর গ্রহণের  কাল পর্যন্ত তার জীবনটা বিপদের পর বিপদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধের কাহিনী।এই বিপদের সঙ্গে লড়াই ক'রতে ক'রতে কখন গ্রীষ্মের প্রচন্ড রৌদ্রতাপে, কখন বর্ষার অবিরাম বারিধারার মধ্য দিয়ে তিনি প্রায় নিজের হাতে ও নিজের তত্ত্বাবধানে সারা ভারতবর্ষে বহু মাইল-ব্যাপী টেলিগ্রাফের  যোগসূত্র স্থাপন করেন।

   নব্বই বৎসরর আগে ভারতবর্ষের অবস্থা কি ছিল আজ তা উপলব্ধি করা বড় সহজ নয়। যখন একগ্ৰাম থেকে অন্যগ্রামে যাবার, এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে প্রবেশ করবার মত ভাল রাস্তা ছিল না। তারপর মাঝে মাঝে এসে প'ড়ত দিগন্তবিস্তীর্ণ দুর্ভেদ্য জঙ্গল- শ্বাপদ, সরীসৃপ ও নানা হিংস্র জন্তুর আবাসভূমি।টেলিগ্রাফের লাইন বিস্তারের পথে আর এক প্রধান বিঘ্ন ছিল বড় বড় নদীগুলি; সেগুলি পারাপার হবার মতো কোন সুব্যবস্থাই তখন ছিল না। প্রাকৃতিক উপদ্রব ছাড়া মানুষের উপদ্রব‌‌ও তখন কম ছিল না।দেশে তখন শান্তিরক্ষার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না বললেই হয়। ডাকাতের উৎপীড়ন তখন ত লেগেই ছিল ।এই সমস্ত বাঁচিয়ে শিবচন্দ্রকে কাজ ক'রে যেতে হয়েছে।তাঁর সঙ্গী ছিল কয়েকজন কুলি, কয়েকজন কেরাণী ও দুচারজন শরীর-রক্ষী। আর তাঁর প্রধান সঙ্গী ছিল তাঁর অনন্য সাধারণ সাহস, ক্ষিপ্রকারিতা ও উপস্থিতবুদ্ধি। কতবার যে তাঁকে মৃত্যুর সামনে মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে হয়েছিল  তার ইয়ত্তা নেই।তবুও অদম্য ছিল তার প্রাণশক্তি- কিছুতেই তিনি দমতেন না।

১৮৫০ খৃষ্টাব্দে লর্ড ডালহাউসি যখন টেলিগ্রাফের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তখন একেই তো ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আর্থিক অবস্থা মোটেই স্বচ্ছল ছিল না; তার উপর শিখ- বিদ্রোহ দেখা দিল।এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে কোম্পানির ধনভান্ডার একেবারে শূন্য হয়ে গেল। এই অবস্থায় ভবিষ্যতের আশঙ্কা স্বভাবতঃই কোর্ট  অব ডিরেক্টরস কে উদ্বিগ্ন করে তুললে ।ঠিক সেই সময় বিলাতের কর্তাদের কাছে লর্ড ড‍্যালহাউসী টেলিগ্ৰাফী সম্বন্ধে আপনার পরিকল্পনা পাঠালেন। বলা বাহুল্য   কোর্ট অব ডিরেক্টার্স  পত্রপাঠ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁরা বলে পাঠালেন, কোম্পানীর আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল নয় কাজেই এই সমস্ত ব্যয়বহুল ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা চলবে না। দ্বিতীয়তঃ ইয়োরোপেই তখন টেলিগ্রাফী সম্বন্ধে নানারকম পরীক্ষাচলেছে; কাজেই ভারতবর্ষে এই পরিকল্পনা কার্যকরী করবার মত উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ পাওয়া যাবে না। কিন্তু লর্ড ড‍্যালহাউসী দমবার পাত্র ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ রাজনীতিবিজ্ঞ ছিলেন ।তিনি দেখলেন অদূর ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের মত একটি বিশাল দেশকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ইংরাজ সৈনিকের শাসনাধীনে রাখতে হলে টেলিগ্রাফের মত প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক শক্তি অপরিহার্য । তিনি বিষয়টি  গেছি ,যদিও এই দুইটিই  ভারতীয় ইতিহাসের স্মরণীয় বস্তু। 

    ভারতবর্ষের‌ এই প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন গঠনের সাফল্যের কথা যখন ইংল্যান্ডে কোর্ট্ অব্ ডিরেকটার্সের কাছে পৌঁছাল,তখন তাঁরা ভারতবর্ষে টেলিগ্ৰাফের প্রচলন সরকারীভাবে অনুমোদন করে নিলেন এবং সেই বৎসরের (১৮৫২ খৃষ্টাব্দের) ডিসেম্বরের মধ্যেই ৩১৫০ মাইল দীর্ঘ টেলিগ্রাফের তার পাঠাবেন বলে জানালেন। 

   এই সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে টেলিগ্রাফ বিভাগে বিশেষ উৎসাহ দেখা দিল। লর্ড ডালহাউসী ডাঃ ওসনেসীকে "সুপারিন্টেণ্ডেন্ট অব্ ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ ইন্ ইন্ডিয়া" পদে নিযুক্ত ক'রে তাঁকেই টেলিগ্রাফ বিভাগের সর্বময় কর্তা করে দিলেন এবং তাঁর বিভাগে তাঁর অধীনস্থ কর্মচারী নিয়োগের সম্পূর্ণ ভার তাঁর হাতেই ছেড়ে দিলেন। সেই সময় ডাঃ ওসনেসী শিবচন্দ্র নন্দীকে " ইন্সপেক্টর- ইন-চার্জ" এই পদে নিযুক্ত করেন। টেলিগ্রাফ- বিভাগে তখন শিবচন্দ্রের পদমর্যাদা ও ক্ষমতা ঠিক ডাঃ ওসনেসীর নীচেই ছিল। পরবর্তী বৎসরে, ১৮৫৩ অব্দে   যখন টেলিগ্রাফের যথেষ্ট বিস্তার হতে আরম্ভ হ'ল এবং কেবল সরকারী কাজের মধ্যেই আবদ্ধ না রেখে টেলিগ্রাফের সুবিধা জনসাধারণকেও গ্রহণ ক'রতে দেওয়া হ'ল তখন লর্ড ড‍্যালহাউসী"ডিরেক্টার জেনারেল অফ্ টেলিগ্ৰাফ্ ইন্ ইন্ডিয়া" এই পদটি নূতন সৃষ্টি করে  ডাঃ ওসনেসীকে সেই পদে নিযুক্ত করলেন এবং তাঁর অধীনে সুপারিন্টেণ্ডেন্ট"ও "অ্যাসিস্টেন্ট সুপারিন্টেণ্ডেট এই দুইটি বিভিন্ন পদে দুইজন ইয়োরোপীয়কে নিযুক্ত করলেন। শিবচন্দ্র পূর্বের ন্যায় "ইন্সপেক্টর ইন্ চার্জ অব্ দি লাইন"এর পদেই বাহাল  রইলেন। এই পদে তাঁর কর্তব্য ছিল তাঁরই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের মধ্যে কুলি- মজুর ও কর্মচারী খাটিয়ে ভারতবর্ষের নানাদিকে নূতন টেলিগ্রাফের লাইন বিস্তার করা ও নবগঠিত লাইনগুলি ঠিক কার্যকরী হচ্ছে কি না সে বিষয়েও বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখা। শিবচন্দ্র এই কর্তব্য নিপুণভাবে সম্পন্ন করেন। এই কাজে তাঁকে পদে পদে যে সমস্ত দুঃখ- কষ্ট ও বিপদ্ বরণ করতে হয়েছে সেগুলি আজ কাহিনী হ'য়ে গেছে। আজ শিবচন্দ্রকে হয়ত লোকে ভুলে গেছে, কিন্তু ৮০।৮৫ বৎসর পূর্বের তাঁর জীবনের এই সমস্ত রোমাঞ্চকর কাহিনী আজ‌ও তাঁর আত্মীয়স্বজনদের মুখে মুখে শোনা যায়।         

   ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দে ২৮ শে ফেব্রুয়ারী যখন টেলিগ্রাফের লাইন ভারতবর্ষে অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হ'য়ে গেছে তখন বড়লাট লর্ড ডালহাউসী টেলিগ্রাফ্ সম্বন্ধে নিম্নলিখিত একটি নোট দেন– "ভারতবর্ষে টেলিগ্রাফের লাইন বিস্তার করতে যে কষ্ট ও অসুবিধা ভোগ করতে হ'য়েছে ইয়োরোপের সভ্য ও সুশিক্ষিত দেশগুলিকে তার কিছুই পেতে হয় নি। এই বিষয়ে একটা কথা বললেই যথেষ্ট  হ'বে যে লাইন ফেলবার পথে ৭০ টি বড় নদী পার হ'তে হ'য়েছে। শোন নদী পার হ'তে ১৯৮৪০ ফিট লাইন পাততে হয়েছিল আর তুঙ্গভদ্রা নদীটী চওড়ায় দুই মাইলের কম ছিল না।" বড়লাট বাহাদুরের এই মন্তব্য প্রকাশিত হ'বার কয়েকমাস পরেই শিবচন্দ্র সাত মাইল প্রশস্ত পদ্মার উপর কেবল  ফেলে যে অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন সে কথা আমরা পরে ব'লব। 

   বড়লাট বাহাদুরের উল্লিখিত মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় তখন এদেশে টেলিগ্রাফের লাইন বসান কতদূর কষ্টকর ছিল। তখন সবেমাত্র রেলপথ খোলা হ'য়েছে; খুব অল্পস্থানেই রেলপথে যাতায়াতের সুবিধা ছিল। সমগ্র উত্তর ভারত তখন এক নিবিড় বনভূমিতে আচ্ছন্ন। কলিকাতার আশে-পাশেই যখন রাত্রে বাঘের ডাক শোনা যেত, তখন এই সমস্ত দুর্গম জঙ্গলে হিংস্র জানোয়ারদের যে কি লীলা চলত তা সমাজেই অনুমেয়। কর্ম-জীবনের অধিকাংশ সময় শিবচন্দ্রকে এই সমস্ত জঙ্গলের পাশে কখন খোলা মাঠে, কখন নদীর ধারে তাঁবু খাটিয়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিতে হ'য়েছে। রাত্রে বিছানার পাশেই গুলিভরা বন্দুক সব সময়ইয় প্রস্তুত থাকত ।  ঘুমের মধ্যেও তার সজাগ চেতনা মৃত্যুর প্রতীক্ষায় উৎকর্ণ হ'য়ে থাকত। সামান্য একটু কিছু শব্দেই তার ঘুম ভেঙ্গে যেত, তারপর হয়ত কোন বিষধর সর্প, নয়ত কোন ভীষণদর্শন ব্যাঘ্ররাজ  তাঁর অব্যর্থ সন্ধানে তাঁবুর পাশেই ভবলীলা শেষ করত । 

সারাদিনের খাটুনির পর রাত্রে হঠাৎ জেগে উঠে শিকারের সম্মুখীন হ'তে যে উপস্থিতবুদ্ধি ও ক্ষিপ্রকারিতার প্রয়োজন শিবচন্দ্রের চরিত্রে সেইটাই ছিল প্রধান বিশেষত্ব। এই ক্ষিপ্রকারিতা ও উপস্থিতবুদ্ধি না থাক্ একদিকে তিনি যেমন অল্পসময়ের মধ্যে সারা ভারতবর্ষে টেলিগ্রাফের তার বিস্তার করতে পারতেন না, অন্যদিকে তেমনি পদে-পদে বিপদের হাত থেকে নিজের ও নিজের সহকর্মীদের জীবন রক্ষা ক'রে যেতে পারতেন না।

   শিবচন্দ্রের জীবনের সাফল্যের আর একটা মূল কারণ ছিল তাঁর সাহস। এই সাহসের চূড়ান্ত পরিচয় তিনি দেখান পদ্মানদীর উপর কেবল্ ফেলবার সময়।

   কলিকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফের তার নিয়ে যাবার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক স্বরূপ এসে দাঁড়াল দুস্তর পদ্মানদী। কীর্তিনাশা পদ্মা চিরদিনই একটা আতঙ্কের বস্তু ।সেই খরস্রোতা নদীর সেই সাত মাইলব্যাপী বিশাল বক্ষের উপর দিয়ে টেলিগ্রাফের কেবল পেতে যাওয়া মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। কর্তৃপক্ষ এই জন্য প্রথম ষ্টীমার কোম্পানীগুলির সঙ্গে বন্দোবস্ত আরম্ভ ক'রলেন। দরকষাকষি চ'লতে লাগল। কোন এক ষ্টীমার কোম্পানীর কাছে শেষে সর্বনিম্ন দর পাওয়া গেল দশহাজার টাকা।

পদ্মা নদীর উপর কেবল ফেলবার জন্য দশহাজার টাকা খরচা করবার মত অবস্থা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া  কোম্পানীর নয়।এই দশহাজারের কথা কোর্ট অব্ ডিরেক্টার্সের কানে তুললে, তাঁরা তৎক্ষণাৎ এই পরিকল্পনা বন্ধ ক'রে দেবেন, এ সুনিশ্চিত। কাজেই সমস্যা বিশেষ জটিল হ'য়ে উঠল।

    তখন শিবচন্দ্র এই সমস্যার অতি সহজ মীমাংসা করে দিলেন,মাত্র কয়েকটি জেলে ডিঙ্গির সাহায্যে সেই দুস্তর ভয়ঙ্করী  নদীর বুকের উপর দিয়ে কেবল ফেলবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক'রে।এই কাজে বিপদের সম্ভাবনা ছিল পদে-পদে।কিন্ত বিপদের ভয়ে শিবচন্দ্র সঙ্কল্পচ‍্যুত  হন নি কোনদিনই;সেদিনও হলেন না।

    সাহস ও দৃঢ় সঙ্কল্পের বলে শিবচন্দ্র সত্যসত্যই কয়েকটি জেলে ডিঙ্গির সাহায্যে পদ্মা নদীর উপর দিয়ে টেলিগ্রাফের কেবল ফেলে গেলেন।তাঁর এই সাফল্যের কথা যখন বিলাতে কোর্ট অব্ ডিরেক্টার্সের কাণে পৌঁছাল, তখন তাঁরা শিবচন্দ্রকে তাঁর এই দুঃসাহসিক কাজের জন্যে সরকারীভাবে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানালেন।সেটা হ'চ্ছে সিপাহী বিদ্রোহের এক বৎসর আগে―১৮৫৬ অব্দের কথা।সেই বৎসর কোর্ট অব্ ডিরেক্টার্সের এক সভায় শিবচন্দ্রের ঐকান্তিকতাপূর্ণ কাজের জন্য প্রশংসা ক'রে একটা প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ভারতীয় টেলিগ্রাফের প্রধান কর্তা ডাঃ উইলিয়াম্  ব্রুক ওসনেসীকে “সার” দিতে ভূষিত করা হয়। 

এইরূপ ঐকান্তিক চেষ্টা ও পরিশ্রমে মাত্র চার বৎসরের(১৮৫২-৫৬) মধ্যে শিবচন্দ্র প্রায় নিজের হাতে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কলিকাতা থেকে ইষ্ট বরাকর, সেখান থেকে এলাহাবাদ,এলাহাবাদ থেকে বেনারস,বেনারস থেকে মিরজাপুর, মিরজাপুর থেকে সিওনী, আর বাংলা দেশে কলিকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত এই দীর্ঘ টেলিগ্রাফের লাইন গঠন করেন।

   শুধু সাহস আর শ্রমশীলতা নয়; শিবচন্দ্রের কাজের মধ্যে একটা বিশেষ নিপুণতা ছিল। তাঁর নির্মিত লাইনগুলি বহুদিন যাবৎ কার্যোপযোগী ছিল ।শুধু পদ্মানদী নয়, তিনি আরও অনেক নদীর উপর শুধু জেলে ডিঙ্গির সাহায্যে কেবল্ পেতেছিলেন; কোথাও তাঁর কাজে নিপুণতার অভাব হয়নি।

   শুধু চাকরী বজায় রাখবার জন্য ও উপরওয়ালাদের খুসী করবার জন্যে শিবচন্দ্র এতখানি পরিশ্রম ও অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করতেন না। টেলিগ্রাফের লাইন গঠনের মধ্যে তিনি খুঁজে  পেয়েছিলেন বিজ্ঞান-সাধনার এক অনাস্বাদিত আনন্দের সন্ধান। জ্ঞানচর্চার একটা অতৃপ্ত পিপাসা তাঁকে এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ইয়োরোপীয় বিশেষজ্ঞদের সাহায্য ব্যতিরেকে ভারতবর্ষে টেলিগ্রাফের প্রবর্তন অসম্ভব, কোর্ট অব্ ডিরেক্টার্স যখন এই অভিমত দেন তখন শিবচন্দ্রের জাতীয় চেতনা কতখানি ক্ষুব্ধ হ'য়েছিল জানি না। কিন্তু ডিরেক্টারগণের এই আশঙ্কা যে কতখানি অমূলক তা তিনি দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর জীবনে প্রমাণ ক'রে গেছেন যে,ইয়োরোপীয় অভিজ্ঞতার কোন সাহায্য না নিয়েও ভারতবর্ষে বিশেষজ্ঞ বৈজ্ঞানিক জন্মাতে পারে।তিনি আরও প্রমাণ ক'রে গেছেন যে, ইয়োরোপের মত সুসভ্য ও সুশিক্ষিত দেশগুলিতে যে খরচে টেলিগ্রাফের প্রচলন কোনদিনই সম্ভব হত না সেই খরচে ভারতে টেলিগ্রাফের প্রচলন করবার মত অসাধ্য-সাধন ভারতবাসী নিজের হাতেই করতে পারে। এক কথায় বিশেষজ্ঞের ও অর্থের অভাবের দরুণ ‌‌ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ডিরেক্টারগণ প্রথমে যে আপত্তি তুলেছিলেন শিবচন্দ্র নিজেই সেই দুইটি অভাব মোচন করে ভারতে টেলিগ্রাফের প্রচলন সহজসাধ্য করেছিলেন।

   তাই মনে হয়, আজ একটা তুচ্ছ বিষয় শিখতেও ভারতবাসীদের ইয়োরোপ আমেরিকা পর্যন্ত ছুটতে হয়। আর তখন শিবচন্দ্র এতবড় যে একটা পরিকল্পনা অনন্য- সহায় হ'য়ে ক'রে গেলেন কতটুকু শিক্ষার উপর নির্ভর করে? কলেজে তিনি পড়েন নি।তাঁর ছাত্রাবস্থায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়নি।তখন এদেশে বিজ্ঞান শিক্ষা দেবার মত কোন বন্দোবস্ত‍ও ছিল না। শিবচন্দ্র স্কুলে সামান্য লেখাপড়া শিখেছিলেন কেরানী-গিরি করবার জন্য।আর সেই কেরানীরূপেই তিনি জীবন আরম্ভ‌ও করেন।তারপর হঠাৎ তাঁর মাথার উপর এমন এক গুরু কর্তব্যের ভার এসে পড়ল,যা সুসম্পন্ন ক'রতে হ'লে আজকের দিনে অনেকগুলি বিদেশী ডিগ্রীর প্রয়োজন হ'ত। কিন্তু শিবচন্দ্র বিনা ডিগ্ৰীতে ও বিনা শিক্ষায় এটা প্রমাণ ক'রে দিলেন যে, একটা দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও একনিষ্ঠ সাধনার বলে আমরা আমাদের অন্তর্নিহিত জ্ঞানের স্ফুরণ ক'রতে পারি,যার কাছে বাহিরের শিক্ষার‍ই কোন তুলনা হয় না।

   টেলিগ্রাফী সম্বন্ধে যাঁর কাছে শিবচন্দ্রের প্রথম হাতেখড়ি হ'য়েছিল,যদিও তিনি তখনকার দিনে এ সম্বন্ধে ভারতবর্ষে একমাত্র প্রামাণিক ব্যক্তি ছিলেন, তবুও তাঁর‌ও প্রথম টেলিগ্রাফী শিক্ষা বেশ একটু বিচিত্র ছিল । ডাঃ ওসনেসী ১৮৩০ অব্দে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে এম্ ডি  উপাধি প্রাপ্ত হ'য়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চিকিৎসা-বিভাগে চাকুরী নিয়ে বাংলায় এলেন। এখানে এসে কলিকাতা মেডিকেল কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হ'লেন। এর পর দশটি বৎসর রসায়ন ও চিকিৎসা-বিজ্ঞান নিয়েই তিনি চর্চা করেন ও এই দুইটি বিষয়ে কয়েকখানি গ্রন্থ‌ও রচনা করেন। হঠাৎ ১৮৩৮ অব্দে এসিয়াটিক্ সোসাইটি অব্ বেঙ্গলের এক সভায় টেলিগ্রাফ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ শুনে এই নূতন বিজ্ঞানটির প্রতি তাঁর ঝোঁক পড়ল এবং কয়েক বৎসরের স্বাধীন চেষ্টায় তিনি এই শাস্ত্রে বিশেষ ব‍্যুৎপন্ন হ'য়ে উঠলেন।তারপর ভারতবর্ষে টেলিগ্রাফের ভিত্তি কতকটা পাকাপাকি ক'রে দিয়ে তিনি “মোস পদ্ধতি”শিক্ষা করবার জন্য ইয়োরোপে যাত্রা করতে মনস্থ করলেন। তাঁকে এই সম্বন্ধে অনুমতি দেবার জন‍্যে লর্ড ড‍্যালহাউসী ৪ঠা আগষ্ট ১৮৫৫অব্দে ডিরেক্টারগণের কাছে আবেদন জানালেন।অনুমতি পাওয়া গেল এবং ডঃ ওসনেসী  বিশেষ শিক্ষার জন‍্যে  ইয়োরোপ যাত্রা করলেন। কিন্তু শিবচন্দ্র এ'সব সুবিধা কিছুই পাননি। প্রকৃতির বিশাল পরীক্ষাগারে তাঁকে তিল তিল করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হ'য়েছে। তবে তাই বলে যে তাঁর পুঁথিগত বিদ্যা আদৌ ছিল না তা নয়।ডাঃ ওসনেসী তাঁকে ইলেকট্রিক্ টেলিগ্রাফ সম্বন্ধে মাঝে মাঝে প্রামাণিক গ্রন্থসমূহ পড়তে দিতেন। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষ হ'লে তাঁবুর পাশে নিস্তব্ধ বনানীর উপর যখন  নিবিড় অন্ধকার নেমে আসত, যখন দূরে শ্বাপদকুলের যুগপৎ হর্ষ ও আর্তনাদের কোলাহল পাশের তাঁবুতে কুলীদের মনে আতঙ্কের সঞ্চার ক'রত। তখন তিনি আপনার তাঁবুতে আলো জ্বালিয়ে সেই গ্রন্থগুলি খুলে বসতেন পরীক্ষার্থী ছাত্রের চেয়েও নিবিষ্টতর চিত্তে।

   ইয়োরোপে ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ সম্বন্ধে তখন‌ও নানা রকম পরীক্ষা চলছে। এই সব পরীক্ষার ফলাফল শিবচন্দ্র জানতে পারতেন উপরোক্ত গ্রন্থগুলির সাহায্যে; কিন্তু এই ফলাফল সব সময় সব ক্ষেত্রে তাঁর কাজে আসত না। ভারতবর্ষের বিচিত্র আবহাওয়া, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন, গ্রীষ্মের সময় প্রচন্ড উত্তাপ, আবার নিবিড় বর্ষায় অবিরাম বারিপাত,ঘন ঘন বিদ্যুতের ঝলক ও বজ্রপাত শিবচন্দ্রের সকল হিসাব ও গণনা ওলট-পালট করে দিত। কাজেই বিলাতী গ্রন্থগুলির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করে, তাঁকে এদেশের বিশেষ প্রাকৃতিক অবস্থার উপর নির্ভর ক'রে পরীক্ষা- কার্য চালাতে হ'ত।এই সমস্ত মৌলিক গবেষণার ফলাফল প্রাচীন কোন্ সরকারী দপ্তরের মধ্যে যে আত্মগোপন করে আছে, আজ আর তা উদ্ধার করা সম্ভব নয়। হয়ত আজ আর তার কোন মূল্য‌ও নেই; কিন্তু ৮৫ বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষে টেলিগ্রাফ-বিজ্ঞানের যখন নিতান্ত শৈশব অবস্থা, তখন শিবচন্দ্রের এই সমস্ত মৌলিক গবেষণার ফলাফল টেলিগ্রাফ-বিভাগের পক্ষে মহামূল্য সম্পদ্ ছিল। এই ব্যক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জন্য শিবচন্দ্র তখনকার দিনে ভারতবর্ষে টেলিগ্রাফ সম্বন্ধে একজন প্রামাণিক ব্যক্তি বলে গণ্য হ'তেন। কিন্তু তাঁর সমস্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার তাঁরি সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হ'য়ে গেল; তিনি ভবিষ্যৎ-বংশীয়-গণের জন্য কোন গ্রন্থ রচনা ক'রে এই জ্ঞানের ভাণ্ডার খুলে দিয়ে গেলেন না। এইখানে তাঁর কর্মবহুল জীবনে রয়ে গেল একটা বড় রকমের ত্রুটি।

   টেলিগ্রাফ-বিভাগে শিবচন্দ্রের অসাধারণ কর্মকুশলতার পরিচয় পেয়ে ডাক-বিভাগেও কোন কোন জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য মধ্যে মধ্যে তাঁর ডাক পড়ত। ডায়মন্ড হারবারের ডাকঘরটি খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নানা রকম বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে লাগল।তখন কর্তৃপক্ষ তার শৃঙ্খলা-বিধানের ও সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানের ভার শিবচন্দ্রের হাতে অর্পণ ক'রলেন।টেলিগ্রাফ-বিভাগের দুর্বিষহ কাজের বোঝা শিবচন্দ্রের মাথার উপর চাপান ছিল, কর্তৃপক্ষ এমনিভাবে তার উপর‌ও দু একটি শাকের আঁটি চাপিয়ে দিতেন।কাজের বোঝা বহন করবার শক্তি শিবচন্দ্রের ছিল অসাধারণ,তাই কিছুতেই তিনি "পারব না" বলতেন না।

   ১৮৫২খৃষ্টাব্দে ভারতবর্ষে প্রথম টেলিগ্রাফের লাইন খোলা হয়; ১৮৫৬ অব্দে,― চার বৎসরের মধ্যেই এখানে ৪০০০ হাজার মাইল দীর্ঘ টেলিগ্রাফের লাইন গড়ে উঠল। এই অসাধ্যসাধন যাঁদের চেষ্টায় হ'য়েছিল শিবচন্দ্রের নাম তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

   লর্ড ডালহাউসী আপনার বড়লাট জীবনের একটি প্রধান স্বপ্ন এমনিভাবে সাফল্যমণ্ডিত হ'তে দেখে ১৮৫৬ অব্দে বিদায় নিলেন।একদিক্ থেকে তিনিও বিদায় নিলেন,অন্যদিক থেকে বেজে উঠল ভারতের বুকে এক প্রলয়ঙ্কর বিদ্রোহের বিষাণ।

   লর্ড ক্যানিং তখন বড়লাট।১০ই মে ১৮৫৭ অব্দের সকাল বেলা ৮ টার সময় টেলিগ্রাফযোগে মিরাট থেকে দিল্লীতে খবর এল যে, সেখানে সিপাহীদের মধ্যে বিশেষ চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে;আর দুএকজন ইংরাজ রাজ- কর্মচারীও নাকি উন্মত্ত সিপাহীদের হাতে মারা গেছেন। বৈকালে ৪টার সময় মিরাট থেকে আর একদফা বিস্তারিত সংবাদ আসবার কথা। দিল্লীর টেলিগ্রাফ অফিস উদ্বিগ্নভাবে সংবাদের অপেক্ষা করতে লাগল কিন্তু তারপর আর কোন‌ও সাড়া-শব্দ মিরাট থেকে পাওয়া গেল না। স্পষ্টই বোঝা গেল পথিমধ্যে লাইনে কোথাও বিঘ্ন হ'য়েছে।পরের দিন সকাল বেলা দিল্লীর টেলিগ্ৰাফ অফিস থেকে মিষ্টার টড্ লাইন পরীক্ষা করতে এবং প্রয়োজন মত মেরামত করতে যাত্রা করলেন।কিন্তু তাঁকে বেশি দূর এগোতে হ'ল না।যমুনার অপরপারে তখন বিদ্রোহীরা সমাবেত হ'চ্ছিল দিল্লী আক্রমণের উদ্দেশ্যে।যমুনা পার হ'বার সঙ্গে সঙ্গে হতভাগ্য টড তাদের হাতে প্রাণ হারালেন।তাঁর খণ্ডবিখণ্ডিত দেহ যমুনার জলে ভাসতে ভাসতে ফিরে এল।এই সংবাদ সেই দিন বৈকালে যখন দিল্লীর টেলিগ্রাফ অফিসে এসে পৌঁছয়,তখন বিদ্রোহীরা দিল্লী আক্রমণ করেছে; আর চারদিকে চলছে অমানুষিক হত্যাকাণ্ড। দিল্লীর টেলিগ্রাফ অফিসে তখনও কয়েকজন ইংরাজ কর্মচারী টডের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।টডের মৃত্যু-সংবাদ পাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা মিসেস্ টড্ ও তাঁর শিশুপুত্রটিকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে দিল্লীর ফ্লাগ স্টাফ্ টাওয়ারে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু পালাবার আগে তাঁরা বুদ্ধি করে আম্বালায় বিদ্রোহের খবরটি পাঠিয়ে যান।*এই সংবাদ দ্রুতগতিতে আম্বালা থেকে লাহোর, রাওলপিণ্ডি,পেশোয়ার ও অন্যান্য স্থানে টেলিগ্রাফযোগে পাঠান হ'ল।এই সংবাদের সাহায্যে বৃটিশ শক্তি ভারতের প্রধান প্রধান কেন্দ্রে বিদ্রোহীদের অতর্কিত আক্রমন হ'বার আগেই সজাগ হ'তে পেরেছিল। ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওলটালেই দেখা যাবে যে,এইরূপে* প্রধানতঃ ইলেকট্রিক্ টেলিগ্রাফের সাহায্যেই সেই মহা বিপদের দিনে বৃটিশের প্রাণ,মান ও সাম্রাজ্য সব‌ই  রক্ষা পেয়ে গেল।এই বৈজ্ঞানিক অস্ত্র যে পদে পদে তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে বিদ্রোহীরা সেটা বুঝেছিল, তাই টেলিগ্রাফের তার কেটে দেওয়া ও টেলিগ্রাফ সিগন্যালারদের হত্যা করা তাদের প্রধান লক্ষ্য হ'য়ে দাঁড়াল।এদিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গভর্ণমেন্ট‌ও দেখলেন যে ,আর ইলেকট্রিক টেলিগ্ৰাফ্ ছাড়া তাঁদের পক্ষে কোনদিকে একপাও অগ্রসর হ'বার উপায় নেই। কাজেই বিদ্রোহ দমন করতে তাঁদের যে তৎপরতার দরকার হয়েছিল,সর্বত্র টেলিগ্রাফের লাইন কার্যকরী রাখবার জন্য তাঁদের তেমনি তৎপরতাই দেখাতে হয়েছিল। যেমন খবর এল আজ অমুক জায়গায় তার কেটে পোষ্ট ভেঙ্গে লাইন নষ্ট করে ফেলা হয়েছে,অমনি নূতন লাইন বসাবার জন্য লোক পাঠান হ'ল।


 *  The Sepoys have come in from Meerut and are burning everything.Mr.Todd is dead,and,we hear,several Europeans.We must shut out.

 

এই কর্মব্যস্ততার দিনে প্রধান কর্মকর্তা হিসাবে ভারতীয় টেলিগ্রাফ-বিভাগ পরিচালনা করবার গুরুদায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে শিবচন্দ্রের মস্তকে স্থাপিত হ'ল।ডাঃ ওসনেসী  তখন বিলাতে। তার স্থলে কর্নেল স্পী ষ্টুয়ার্ট অস্থায়ীভাবে ডিরেক্টার্ জেনারেল হিসাবে কাজ করছিলেন।বিদ্রোহ তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কর্নেল ষ্টুয়ার্টের ডাক পড়ল‌। তিনি শিবচন্দ্রকে অস্থায়ীভাবে আপনার পদেয় বসিয়ে লড়াই করতে গেলেন।শিবচন্দ্রের বয়স তখন বেশী নয়,মাত্র তেত্রিশ।সেই থেকে তিনি এই গুরু দায়িত্বের বোঝা মাথায় তুলে নিলেন। ভারতবর্ষের চারিদিকে তখন দুর্যোগের ঘনঘটা। তারি মধ্যে শিবচন্দ্র তাঁর  অসাধারণ সাহস ও স্থিরবুদ্ধির সাহায্যে নিপুণভাবে ১৮৫৭ ও ১৮৫৮ এই দুই বৎসর ভারতীয় টেলিগ্রাফ-বিভাগ পরিচালনা করেন।

   বিদ্রোহের অবসানে বড়লাট লর্ড ক্যানিং থেকে আরম্ভ করে প্রায় সকল বিশিষ্ট রাজকর্মচারীকে স্বীকার করতে হ'য়েছিল যে, ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ‌ই তাঁদের সম্ভ্রম ও সাম্রাজ্য দুই রক্ষা করেছে।অথচ কার বিরামবিহীন পরিশ্রম ও কর্মদক্ষতা,কার একনিষ্ঠ কর্তব্যপরায়ণতা যে এই সময় টেলিগ্ৰাফ্-বিভাগটিকে সর্বতোভাবে কার্যোপযোগী করে রেখেছিল তার প্রতি হয়ত সকলের দৃষ্টি পড়েনি।দুর্যোগের ঘনঘটায় তিনি কতকটা যবনিকার  অন্তরালে গিয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য সরকারীভাবে এইটুকু মাত্র স্বীকার করা হ'য়েছিল যে,সিপাহী-বিদ্রোহের সময় ভারতীয় টেলিগ্রাফ-বিভাগের সর্বপ্রধান কর্মকর্তা হিসাবে তিনি চমৎকার কাজ দেখিয়েছেন।*


    *   During the mutiny of 1857,he rendered excellent service,sometime acting as head of the Telegraph Department's head quarters .–Sir Roper Lethbridge K.C.I.E.


   বিদ্রোহের সময় যে সমস্ত টেলিগ্রাফ সিগন‍্যালার বিদ্রোহীদের হস্তে নিহত হ'য়েছিলন তাঁদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে ১৯০২ অব্দে ১৯ শে এপ্রিল শনিবার ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয় ও গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন দিল্লীতে মিউটিনি টেলিগ্রাফ মেমোরিয়্যালের উদ্বোধন করেন।এই উপলক্ষে দিল্লীতে ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে আমন্ত্রিত বিশিষ্ট রাজকর্মচারী ও ভারতীয়দের নিয়ে একটি সভা  হয়। লর্ড কার্জন এই সভার সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় শিবচন্দ্র নন্দীকে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত করা হয় প্রকাশ্য জনসভায় তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য।

   সভাপতির বক্তৃতার পর ভারতীয় টেলিগ্রাফের তদানীন্তন ডিরেকটার জেনারেল্ মিষ্টার ম‍্যাকলীন্ বক্তৃতা করতে উঠে শিবচন্দ্রকে সভা ও সভাপতির নিকট পরিচয় করিয়ে দিয়ে নিম্নলিখিত বক্তৃতাটি করেন― “আমি  আপনাদের সমক্ষে রায় বাহাদুর শিবচন্দ্র নন্দীর পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। ইনি ছিলেন ভারতীয় টেলিগ্রাফ বিভাগের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট।টেলিগ্রাফ বিভাগের ইনিই হচ্ছেন সর্বাপেক্ষা পুরাতন কর্মচারী।পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ভারতীয় টেলিগ্রাফের প্রথম ডিরেক্টার জেনারেল স্বর্গীয় সার উইলিয়াম ওসনেসী যখন এদেশে টেলিগ্ৰাফ-বিভাগ স্থাপন করেন তখন ইনিই সর্বপ্রথম সেই বিভাগে যোগদান করেন।পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে সার উইলিয়ামের দক্ষিণ হস্তস্বরূপ থেকে বহু বাধাবিঘ্নের মধ্য দিয়ে ইনিই প্রথম ভারতবর্ষে ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফের প্রবর্তন করেন।আজ যে      ঘটনার স্মৃতিরক্ষাকল্পে এই সভার আয়োজন করা হয়েছে,ইনি প্রত্যক্ষভাবে তার সহিত জড়িত না হলেও এই টেলিগ্ৰাফ-বিভাগের যখন অতি শৈশব অবস্থা তখন  ইনি সারা ভারতের বিভিন্ন অংশে এই বিভাগের উন্নতিকল্পে যে কাজ দেখিয়েছেন তা যথার্থই অতি মূল্যবান।”


       I desire to present Rai Seeb Chunder Nandi Bahadur,late Assistant Superintendent of Telegraphs, the oldest Telegraph officer in India, and who joined the department more than fifty years ago on its establishment by the late sir 'O'Shaughnessey, the first Director General of Telegraphs whose right hand he was in overcoming the many difficulties experienced in the introduction of the Electric Telegraph into India.


ম‍্যাকলীন্ সাহেবের বক্তৃতার এই অংশ শেষ হ'বার সঙ্গে সঙ্গে শিবচন্দ্রকে অভিনন্দিত করে চারদিক্ থেকে বহুক্ষণ ধরে একটা তুমুল হর্ষধ্বনি উত্থিত হ'ল।

   জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ শিবচন্দ্র সেদিন  অবনতমস্তকে জনসাধারণের সেই শ্রদ্ধানিবেদন গ্রহণ ক'রেছিলেন।জীবনের মধ‍্যাহ্ণে যখন তিনি  উল্কার মত বেগে ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে   বেড়াচ্ছিলেন টেলিগ্রাফের যোগসূত্র স্থাপন করতে, তখন তাঁর চোখের সামনে অর্থের বা যশের বাহ্যিক কোন অনুপ্রেরণাই ছিল না।  নিরবিচ্ছিন্ন  কাজের  মধ্যেই ডুবে থাকবার যে সহজ আনন্দ কেউ কেউ পেয়ে থাকেন,সেই আনন্দ‌ই ছিল শিবচন্দ্রের জীবনে সব চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা এবং এই অনুপ্রেরণার বলেই তিনি সারা জীবনব‍্যাপী কাজের মধ্যে এতখানি  একনিষ্ঠতা দেখিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

   সিপাহী-বিদ্রোহের অনিশ্চয়তার দিনে যখন ভারত- শাসনের একটি বিশিষ্ট বিভাগ সম্পূর্ণরূপে শিবচন্দ্রের করতলগত ছিল,তখন শোনা যায় যে শিবচন্দ্রকে হস্তগত করতে বিদ্রোহীদের তরফ থেকে অনেক প্রলোভন দেখান হ'য়েছিল;এমন কি রাজকীয় সম্মানের‌ও  লোভ দেখান হ'য়েছিল।কিন্তু বিদ্রোহীরা কিছুতেই শিবচন্দ্রকে জয় করতে পারেনি।


Although not directly connected with the events which we have commemorated,Rai Seeb Chunder Nandi Bahadur rendered valuable services during the infaney of the Department in many parts ofIndia.(Applause).Extract from“The Morning Post”dated the 21st.April1902.


   শিবচন্দ্রের চরিত্রে এতটাই ছিল প্রধান বিশেষত্ব। সিপাহী-বিদ্রোহের গোলমাল থেমে যাবার পর অনেকেই  আশা করেছিল যে, ভারত সরকারের তরফ থেকে তাঁকে একটা মোটা রকমের পুরস্কার দেওয়া হবে,অন্ততঃ চাকুরীর দিক্ দিয়ে তার পদমর্যাদা কিছু বাড়িয়ে দেওয়া হ'বে;কিন্তু সে সব যখন কিছুই করা হল'না তখনও   শিবচন্দ্রের কাজের সহজ স্রোতে কোন ভাটা দেখা গেল না।

   তিনি আবার নবীন উৎসাহে নূতন লাইন গঠনকার্যে আত্মনিয়োগ করলেন। সিপাহী-বিদ্রোহের কাল পর্যন্ত কলিকাতা থেকে বোম্বায়ে টেলিগ্রাম পাঠাতে হ'লে  দিল্লী হ'য়ে ঘুরে যেতে হ'ত। বিদ্রোহের সময় দিল্লীই ছিল   বিপক্ষদের প্রধান কেন্দ্র ।কাজেই দিল্লীর লাইনে প্রায়ই বিঘ্ন ঘটতে দেখা যেত এবং কলিকাতা থেকে বোম্বায়ে টেলিগ্রাম পাঠান মাঝে মাঝে একরকম  অসম্ভব  হ'য়ে উঠত।  বিদ্রোহের সময় প্রধান কর্মকর্তা হিসাবে এই অভিযোগ তাঁকে প্রায় শুনতে হ'য়েছিল।  তাই বিদ্রোহের অবসানে  কলিকাতা থেকে  বোম্বাই পর্যন্ত মির্জাপুর ও জব্বলপুরের পথে অপর একটি লাইন গঠনের পরিকল্পনা তিনি ডিরেক্টার জেনারেলের নিকট পেশ করেন।বলাবাহুল্য যে,তাঁর এই পরিকল্পনাটি সঙ্গে সঙ্গে ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত হ'ল,এবং এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কলকাতা থেকে বোম্বাই পর্যন্ত নূতন  লাইন গঠনের সম্পূর্ণ ভার তাঁরই হাতে ন‍্যস্ত হ'ল। শিবচন্দ্র আবার পুর্ণোদ‍্যমে  কাজে লেগে গেলেন এবং কয়েক বৎসরের কঠিন পরিশ্রমে লাইনটি সুষ্ঠুভাবে গঠন করেন। এই লাইনের কাজ শেষ হ'বার সঙ্গে সঙ্গে শিবচন্দ্র কলিকাতা থেকে হায়দ্রাবাদ পর্যন্ত আর একটি লাইন গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।এই লাইনটি কলিকাতা থেকে জব্বলপুর ও নাগপুর হ'য়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে।এই লাইনের কাজ শেষ করতে শিবচন্দ্রের আরও কয়েক বৎসর লাগে।

   এই দুইটি লাইন গঠন-কার্য শিবচন্দ্রকে অনেকগুলি বড় বড় নদী অতিক্রম করতে হ'য়েছিল। কিন্তু কোথাও তিনি ষ্টীমারের সাহায্য গ্রহণ করেননি ।বরাবর কতকগুলি জেলে ডিঙ্গীর সাহায্যেই এই সমস্ত দুস্তর নদীগুলির উপর দিয়ে কেবল ফেলে গিয়েছিলেন। ফরিদপুরের  নিকট দুরন্ত পদ্মানদীর উপর দিয়ে কেবলমাত্র কয়েকটি  জেলে ডিঙ্গীর সাহায্যে কেবল পেতে গিয়ে তিনি যে অনন্যসাধারণ সাহস ও কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে গেছিলেন তার কথা আগেই বলেছি।সেই ঘটনায় তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন,তার দ্বারা ছোট বড় কোন নদীর উপর কেবল পাতা তাঁর  পক্ষে খুব সহজসাধ্য ব্যাপার হ'য়ে দাঁড়িয়েছিল।

উপরোক্ত দুইটি লাইনের কাজ শেষ হ'বার পর ১৮৬৬ অব্দে তাঁকে ভরতীয় টেলিগ্রাফ বিভাগের সহকারী সুপারিন্টেণ্ডেন্টের পদে উন্নীত করা হয়। অবসর গ্রহণের কাল পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। মধ্যে কয়েকমাস তদানীন্তন ডিরেক্টার জেনারেল্ কর্ণেল  পী ষ্টুয়ার্ট, সিংহলে টেলিগ্ৰাফ বিভাগের উদ্বোধন উপলক্ষে ভারতবর্ষ ছেড়ে সিংহলে অবস্থান করায়,শিবচন্দ্র অস্থায়ীভাবে তাঁর পদে কাজ করেছিলেন।

   তখনকার দিনে সরকারী সকল বিভাগেই উচ্চতম পদগুলিতে ভারতীয়দের নিয়োগ করার প্রথা ছিল না। সেই জন্য শিবচন্দ্রকে স্থায়ীভাবে ডিরেক্টার জেনারেলের পদে নিযুক্ত করা হয়নি‌। কিন্তু সার উইলিয়‍্যাম  ওসনেসীর বিদায় নেবার পর থেকে ভারতীয় টেলিগ্রাফ-বিভাগে তার চেয়ে অভিজ্ঞ ও প্রামাণিক ব্যক্তি আর কেহ ছিলেন না। এই বিশাল ভারতের বহুমাইলব্যাপী টেলিগ্রাফের লাইনগুলি একেবারে তাঁর নখদর্পণে ছিল এবং এই লাইনগুলির মধ্যে কোথাও কোন  গোলযোগ দেখা দিলে প্রথমেই তাঁর পরামর্শ ও নির্দেশের প্রয়োজন হ'ত।শিবচন্দ্রের কার্যকালে যে কেহ ডিরেক্টার জেনারেল বা সুপারিন্টেণ্ডেন্টের পদে নিযুক্ত ছিলেন তাঁরা সকলেই শিবচন্দ্রের মতামতের উপর একটি বিশেষ আস্থা রাখতেন।

   এই ভাবে ৩৮ বসরব্যাপী প্রাণপাত পরিশ্রমের পর ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তখন তাঁর  বয়স ৬০ বৎসর।কিন্তু বার্ধক্য তখনও তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।তিনি অবসর গ্রহণ করলেন কিন্তু বিশ্রাম গ্রহণ করলেন না।অবসর গ্রহণের পর তিনি আরও ১৯ বৎসর বেঁচে ছিলেন।এর মধ্যে তাঁর কাজের অভাব ছিল না,স্বাস্থ্যেরও অভাব ছিল না।

   শোনা যায় অবসর গ্রহণের সময় সরকার পক্ষ থেকে শিবচন্দ্রকে এককালীন্ বিশ বা পঁচিশহাজার টাকা পুরস্কার দেবার একটা প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু শিবচন্দ্র  সে প্রস্তাবে রাজী হন নি।

    টেলিগ্ৰাফ-বিভাগের গোড়াপত্তন থেকে শিবচন্দ্র এই বিভাগের জন্য যে প্রাণপাত পরিশ্রম ক'রেছিলেন, সরকারী তহবিলের দুপয়সা বাঁচাতে গিয়ে তিনি যেভাবে পদে পদে নিজের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করেছিলেন, তার যথার্থ মর্যাদা হয়তো ঐ কয়েক সহস্র মুদ্রার মাপকাঠিতে  হয় না।

   শিবচন্দ্রের মধ্যে একটা দৃঢ় আত্মসম্মানবোধ ছিল, আর ছিল পাটোয়ারী মনোবৃত্তির একান্ত অভাব।তাই কাজের শেষে এই সরকারী বকশিসের প্রস্তাব তাঁর মনঃপূত হয়নি।যাই হ'ক কর্তৃপক্ষ তাঁর এই ব্যবহারে খুসীই হ'য়েছিলেন এবং তাঁর জন্য একটি “বিশেষ পেনসনের”বন্দোবস্ত করেন।

   অবসর গ্রহণের একবৎসর পূর্বে ১৮৮৩ অব্দের ২৮শে ফেব্রুয়ারী গভর্ণমেন্ট‌ তাঁকে “রায় বাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত করেন।কয়েক বৎসর পরে তাঁর কার্যাবলীর আলোচনা প্রসঙ্গে “ষ্টেটসম‍্যান” ও  “মর্ণিং পোষ্ট” পত্রিকা  মন্তব্য করেন-“তিনি যে চমৎকার কাজ দেখিয়েছেন,তার তুলনায় “রায় বাহাদুর” উপাধি অতি নগণ‍্য পুরস্কার।”*

   অবসর গ্রহণের পর গভর্ণমেন্ট‌ তাঁকে শিয়ালদহের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটের পদে নিযুক্ত ক'রে সম্মানিত ক'রবার চেষ্টা করেন‌।এই পদে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন; এবং এক্ষেত্রেও তিনি তাঁর জীবনের স্বাভাবিক শ্রমশীলতার ও বিচক্ষণ বিচারবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে গেছেন। মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে তিনি  শেষ এজলাসে বসেন।

  তাঁর মৃত্যুর পর কলিকাতা করপোরেশন্ তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে তাঁর নাম অনুসারে সহরের একটি রাস্তার নামকরণ করেন।রাস্তাটির নাম “শিবু নন্দী লেন”। শিবু নন্দী লেন পাঁচের ওয়ার্ডে শিব ঠাকুর লেন থেকে সুরু হ'য়ে সিকদারপাড়া স্ট্রীটে গিয়ে শেষ হ'য়েছে। এই শিবু ঠাকুর লেনেই শিবচন্দ্রের বাস ছিল।

   তাঁর স্বাস্থ্য বরাবরই ভাল ছিল।বস্তুতঃ এই স্বাস্থ্যই ছিল  তাঁর জীবনের একটা পরম সম্পদ।৭৯ বৎসর বয়সে প্লেগে তাঁর যখন মৃত্যু হয় তখনও তাঁর স্বাস্থ্যের বাঁধন দৃঢ় ও সতেজ ছিল।বয়স আশীর কাছাকাছি গেলেও বার্ধক্যের জড়তা তাঁকে স্পর্শ ক'রতে পারেনি। মাত্র তিন দিনের অসুখে তাঁর মৃত্যু হয়;এই তিন দিন বাদ দিয়ে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি নিজের দৈনন্দিন কাজ স্বাভাবিক ভাবেই ক'রে গেছেন। মৃত্যুর পাঁচদিন আগে তিনি যথারীতি কোর্টে বিচার ক'রে আসেন।


  *   A Rai Bahadurship seems to have been a poor reward for his excellent services. (The Statesman 25.4.02;The Morning Post 21.4.02)


   ১৯০৩ অব্দে কলিকাতায় প্লেগ ব্যাধি মহামারি রূপে দেখা দেয়। ১৯০৩ অব্দের এপ্রিল মাসে স্টেটসম‍্যান ত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যায় যে,সেই সময় কলিকাতা সহরে প্রত্যহ ১৫০ থেকে ১৬০ জন ক'রে  প্লেগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং দৈনন্দিন মৃত্যুসংখ্যা ছিল গড়ে ১১৬ জন।এই ব্যাধির প্রকোপে সে বৎসর  বহুগৃহে মৃত্যুর করালছায়া এসে পড়েছিল।এই করালছায়া শিবচন্দ্রের অফুরন্ত উৎসাহদীপ্ত জীবনেও এসে পড়ল এবং মাত্র তিন দিনেই তাঁর জীবনদীপ  নির্বাপিত ক'রে দিয়ে গেল‌

   সেদিন সোমবার ২৩ শে চৈত্র ১৩০৯, ইংরাজি তারিখ ৬ই এপ্রিল ১৯০৩। অন্নপূর্ণা পূজার বিসর্জন।প্রতি বৎসর  তাঁর বাড়ীতে অন্নপূর্ণা পূজা হয়;সে বৎসরও যথারীতি পূজার আয়োজন করা হ'য়েছিল।প্রতিমাকে বাড়ীতে এনে বসিয়েই হঠাৎ তিনি অসুস্থ হ'য়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল জ্বর ও প্লেগের অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিল।দুদিন পরে বিসর্জনের দিন দেবীর নিরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনের সকল আশা নিবে এল। সেই দেখে পুরোহিত পূর্বাহ্ণেই প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা ক'রলেন।একদিক্ দিয়ে প্রতিমাকেও বাড়ীর বাহির করা হ'ল আর অন্যদিক্ দিয়ে তিনিও শেষ নিশ্বাস ফেলে ইহজগৎ থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন,মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে।তাঁর মৃত্যু তাঁর জীবনের মতই ছিল বেশ একটু বিচিত্র।

   মৃত্যুর সংবাদ পাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ক'রতে টেলিগ্রাফ-বিভাগের কলিকাতাস্থ প্রধান কার্যালয়ের সকল বিভাগ সেই দিনের জন্য ছুটী দেওয়া হয়।তখনকার কোন কোন দৈনিক সংবাদপত্রে তাঁর জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণী সহ তাঁর মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করা হয়।ভারতবর্ষের সরকারী ও বেসরকারী বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে সান্ত্বনা ও সমবেদনাজ্ঞাপক বহু পত্র তাঁর পুত্রদের নিকট আসতে থাকে।

   শিবচন্দ্রের মৃত্যুর সময় কলিকাতাসহরবাসী একটা দারুণ উদ্বেগের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিল।প্লেগের অতর্কিত আক্রমণে মহাকালের আহ্বান কখন যে কার কাছে পৌঁছয় তার কিছুই স্থিরতা ছিল না।তাঁর মৃত্যুর দুইদিন পরে তাঁর বড় আদরের জ্যেষ্ঠ পৌত্র এই আহ্বানে স্নেহময় পিতামহের পশ্চাদনুসরণ ক'রলে। শিশুর জীবনের এই ছোট্ট ট্রাজেডি বৃদ্ধের বিয়োগ-বেদনা ভুলিয়ে দিয়ে গেল।

   জীবনের শেষ কয় বৎসর অবসরময় জীবনযাপন ক'রলেও তাঁকে কখন ব'সে থাকতে দেখা যেত না।দেশের ছোটবড় বহু সামাজিক ও জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এখনও একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে যে,তিনি চাঁদার খাতায় নাম সহি ক'রে ক'রেই ফতুর হ'য়ে গেছেন।

   তিনি ছিলেন সুবর্ণবণিক্-সম্প্রদায়ভুক্ত।তিনি বাঘনাপাড়ার গোস্বামীদিগের শিষ্য ছিলেন।অত্যন্ত  গোঁড়া ও রক্ষণশীল হ'লেও তাঁর ধর্মমত তাঁর জীবনের মতই ছিল স্বাধীন ও উদার।কর্মসূত্রে তাঁকে যখন সারা- ভারত ভ্রমণ ক'রতে হ'য়েছিল তখন নানা তীর্থ-দর্শন করবারও সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন।এই সম্বন্ধে তিনি শেষ জীবনে গল্প করতেন―“আমি বহু তীর্থ দর্শন ক'রেছি,কিন্তু কোথাও দানও করিনি,স্নানও করিনি।” এই থেকেই বোঝা যায় তিনি লৌকিক ধর্মের সঙ্কীর্ণতার  কত ঊর্ধ্বে ছিলেন।

   একজন বিশিষ্ট সরকারী কর্মচারী হিসাবে সরকারী মহলে তাঁর বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল;কিন্তু তাই বলে যে বে-সরকারী মহলেও তাঁর প্রসার-প্রতিপত্তি বড় কম ছিল না। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,কেশবচন্দ্র সেন প্রভৃতি তদানীন্তন জননায়কদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ হৃদ‍্যতা ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। এরা প্রায়ই শিবঠাকুরের লেনে তাঁর বসত বাড়ীতে আসতেন,তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ক'রতে।বন্ধুদের  উপর শিবচন্দ্রের প্রভাবও ছিল অত্যন্ত বেশী। তাঁর অন্যতম বিশিষ্ট বন্ধু কলিকাতার ছোট আদালতের তদানীন্তন বিচারক নবাব বাহাদুর এ এফ্ এম্ আব্দার রহমন্ তাঁর মৃত্যুর ১২ বৎসর পর সহরের কোন একটি বিদ্যালয়ের পারিতোষিক বিতরণী সভায় সভাপতিত্ব ক'রতে গিয়ে “রায় বাহাদুর শিবচন্দ্র নন্দী স্মৃতি-পুরস্কার” নাম দিয়ে কয়েকটি পুস্তক পুরস্কার দিয়ে আসেন।এই একটা ঘটনা থেকে বোঝা যায় তাঁর অমায়িক ব্যবহার সম্প্রদায়নির্বিশেষে তাঁর সকল বন্ধুর মনের উপর কি  গভীর রেখাপাতই না ক'রে আছে।

   শিবচন্দ্রের জীবনে যা কিছু উন্নতি সবই তাঁর স্বকৃত পিতার কাছ থেকে তিনি বিশেষ কোন সাহায্য পান নি। এমন কি যখন বাইশ বৎসর বয়সে টাঁকশালে তিনি কেরাণীর পদ গ্রহণ করেন তখন তাঁর পিতার সংসারে  তাঁর উপার্জনের বিশেষ প্রয়োজন হ'য়েছিল।তাঁর পিতা ঁসাতকড়ি নন্দীর অবস্থা বিশেষ স্বচ্ছল ছিল না।

  শিবচন্দ্রের মায়ের নাম ছিল হীরামণি দাসী।মাকে তিনি অত্যন্ত ভক্তি করতেন। কর্মসূত্রে বেশীরভাগ সময় মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে হ'ত বলে মায়ের উপর শেষ পর্যন্ত শিশুপুত্রের মতই তাঁর একটা টান ছিল।

   তিনি দুইবার দারপরিগ্রহ করেন। প্রথম পত্নী বিবাহের অল্পকয়েক বৎসরের মধ্যে অপুত্রক অবস্থায় মারা যাওয়ায় তিনি দ্বিতীয়বার  রামসেবক দত্তের কন্যা অঙ্গদেবীকে বিবাহ করেন। অঙ্গদেবীর প্রথম কয়েকটি শিশুপুত্র জন্মের অল্পদিনের মধ্যেই মারা যায়।পরে তাঁর তিন পুত্র ও এক কন্যা জন্মে।শিবচন্দ্রের মৃত্যুর সময় এই চারিটি সন্তান জীবিত ছিলেন। অধিক বয়সের এই সন্তানদের প্রতি তাঁর মমতার অন্ত ছিল না।

   তাঁর পারিবারিক জীবন সুখেরই ছিল। কিন্তু পারিবারিক জীবনের আরামটি তিনি ষাট বৎসর বয়সের আগে ভোগ করবার সুযোগ পান নি।তাঁর যথার্থ পারিবারিক জীবন আরম্ভ হয় এই ষাট বৎসর বয়সে পেন্সন নেবার পর থেকে। পেন্সন নেবার পর যে উনিশ বৎসর তিনি বেঁচে ছিলেন,সেই কয় বৎসরই তিনি পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রকৃত আনন্দ-কোলাহলে যোগ দিতে পেরেছিলেন। তার পূর্বে তাঁর আসল জীবনটা কেটেছিল ভারতবর্ষের নদী,অরণ্যানী ও বিশাল মাঠের বুকে।

   তারই ভিতর দিয়ে যে বৈচিত্র্যের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন জীবন-সায়াহ্নে আপনার শিশু সন্তানদের কাছে নিয়ে তিনি সেই সব রোমাঞ্চকর দুঃসাহসিক ঘটনাবলী গল্প করে শোনাতেন।

   কেমন করে একবার টেলিগ্রাফের পোষ্ট পোতবার জন্য উপযুক্ত জমির সন্ধান করতে করতে তিনি আকন্ঠ চোরাবালিতে ডুবে যান এবং কেমন করে তাঁর শরীর- রক্ষীদের চেষ্টায় সে যাত্রায় রক্ষা পান;কেমন ক'রে কখন বাঘের মুখে,কখন ভীষণ বন‍্য অজগরের মুখে পড়েও তিনি তাঁর সহজাত ক্ষিপ্রকারিতার গুণে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত এড়াতে পেরেছিলেন; কেমন করে একবার একদল উদ্ধত গোরা সৈনিক বেয়াদবী করতে গিয়ে তাঁর কাছে অপমানিত হয়ে ফিরে যায়,আবার কেমন করে সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে গোরার দল গোপনে গোপনে তাঁর প্রাণ সংহারের ষড়যন্ত্র করেছিল এবং কেমন করে পরিশেষে তাঁর বিরাট্ ব্যক্তিত্বের কাছে পরাজিত হ'য়ে তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হ'য়েছিল;কেমন করে একবার উত্তর ভারতের এক দেশীয় নৃপতির বেআইনী হুকুম পালন করতে অস্বীকার করায় তাঁকে সদলবলে পুড়িয়ে মারতে মাঝরাত্রে তাঁদের সমস্ত তাঁবুগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়; এই সব বহু গৌরবময় বিচিত্র কাহিনী শিশুরা বসে বসে শুনত তাদের মহান্ পিতার নিজের মুখ থেকে।

   শিবচন্দ্রের পুত্রগণ কেহই পিতার মত দীর্ঘ জীবন  ও অনবদ্য স্বাস্থ্য লাভ করতে পারেন নি। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ঁআশুতোষ নন্দী ৫১ বৎসর বয়সে,মধ্যম পুত্র ঁশম্ভুনাথ নন্দী মাত্র ২৯ বৎসর বয়সে ও কনিষ্ঠ পুত্র ঁকাশীনাথ নন্দী ৪৫ বৎসর বয়সে ইহলোক ত‍্যাগ করেন।মৃত্যুকালে জ্যেষ্ঠপুত্র ঁআশুতোষ নন্দী একাউন্টেন্ট জেনারেল্ বেঙ্গল, পোষ্ট এণ্ড টেলিগ্ৰাফ অফিসে সুপারিন্টেণ্ডেন্টের পদে নিযুক্ত ছিলেন ও কনিষ্ঠপুত্র  ঁকাশীনাথ নন্দী মেসার্স  অরডিগ্ নাম এন্ড কোম্পানী নামক বিখ্যাত সলিসিটার অফিসে সহকারী  সলিসিটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদ অধিকার করে ছিলেন।দুই ভাইই জীবনের ঠিক উন্নতির মুখেই মৃত্যুমুখে পতিত হন।

   সন্তানদের মধ্যে বর্তমানে তাঁর বিধবা কন্যা শ্রীমতী তারকদাসী জীবিত আছেন।এই মেয়েটিকে শিবচন্দ্র অত্যন্ত ভালোবাসতেন;এবং বহু অর্থ ব্যয়ে বহু সুখের স্বপ্নের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর এই আদরের মেয়েটির বিয়ে দেন কলিকাতা সহরের এক প্রসিদ্ধ ধনীর একমাত্র পুত্রের সঙ্গে।মাধব দত্তের নাম অনেকেই শুনে থাকবেন; তাঁরই প্রপৌত্র পান্নালাল দত্তের সঙ্গে তারকদাসীর বিয়ে হ'ল।কিন্তু ভবিতব্য কে খণ্ডন করবে?বিয়ের এক বৎসরের মধ্যেই পিতার কোলে আবার তিনি ফিরে এলেন বিধবার বেশ প’রে! স্নেহময় পিতার শেষ জীবনে  এই আঘাত অত্যন্ত দুর্বিষহ হ’য়েছিল।

     ১৯০০খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত Sir Roper Lethbridge K.C.I.E প্রণীত“ The Golden Book of India” এর ২৯১ পৃষ্ঠায় রায় বাহাদুর শিবচন্দ্র নন্দীর নিম্নলিখিত সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশিত হয়―

    “Shib Chunder Nandi, Rai Bahadur,born June 1824.The title was conferred as a personal distinction on February 28,1883,in recognition of his eminent services to the country in connection with the construction and development of telegraphs . He entered the service of the Government.

 in 1846 under Sir William ‛O’Shaughnessy in the Mint; and when Sir William commenced telegraph operations the Rai Bahadur was placed in charge of the work and constructed the first experimental telegraph-line in India,that between calcutta and Diamond Harbour.During the mutiny of 1857 he rendered excellent service,sometime acting as the head of the Telegraph Department's head quarters; and in order to secure the communication between  Calcutta and Bombayh,He laid down a portion of the alternative line from Mirzapur to Seoni via Jubbulpur.He became an Assistant Superintendent of Indian Telegraphs in 1866;and  retired on special pensions in 1884,in which year he was made an Honorary Magistrate Residence,Calcutta Bengal.”

   ১৯০২ খৃষ্টাব্দে এপ্রিল মাসে দিল্লীতে “Mutiny Telegraph Memorial” এর উদ্বোধন-উৎসব সম্পন্ন হয় তখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন সংবাদপত্রে শিবচন্দ্রের জীবন- বৃত্তান্ত নিয়ে কিছু কিছু মন্তব্য প্রকাশিত হয়।এই উপলক্ষে “The Statesman” পত্রিকায় ১৯০২,২৫শে এপ্রিল তারিখে নিম্নোদ্ধৃত মন্তব্যটি প্রকাশিত হয়―

   “Shib Chunder Nundi,Rai Bahadur,who had the honour of being presented to the Viceroy on Saturday, at the unveiling ceremony of the Telegraph Memorial at Delhi, has a fine record. He first entered the service of Government in 1846, when he was employed in the Refinery Department of the Calcutta Mint under Dr. W. B. 'O'Shaughnessey and when that officer was about to commence telegraph operations in India he placed Babu Seeb Chunder Nundi with the sanction of Government in charge of the work. This was practically his transfer to what afterwards became the Telegraph Department in which he remained ever after. His career in the Department, therefore, commenced with the construction of the first telegraph line that was ever put up in this country, viz .from Calcutta to Diamond Harbour and Kedgeree, on the Hooghly. On the completion of this line he was appointed by Government an Inspector in charge of it under the direct Superintendence of Dr. O'Shaughnessey. He had also to instruct the *signallers and to conduct experiments in connection with electrical matters for the proper working of the line, which in itself was experimental.He was afterwards appointed to the charge of the Post office at Diamond Harbour in addition to his  other duties. He subsequently constructed about 900  Miles of line, viz., from East Barrakur to Allahabad, from Benaras to Mirzapur, from Mirzapur to Seonee, and from Calcutta to Dacca. On completing the later line he laid a cable across the Pudda River at Fureedpur about seven miles in length by the aid of fishing boats only, at a large savings to Government, the price asked in those days for a steamer for the purpose being Rs. 10,000. He laid many cables after and in every case successfully and without the aid of steamers,   the cables working well for many years after- wards.Babu Seeb Chunder Nundi  received the thanks of Government in 1856 for good and zealous service,and his services were brought to the notice of the Honourable Court of Directors   of the East India Company and acknowledged by them in the same year.On the outbreak of the Mutiny the Department was under the control  of the late colonel. P.Stewart,who was then officiating as  Director General for Dr.‛O’Shaughnessey on leave in Europe.During colonel Stewart's absence in ceylon in connection with the construction of telegraph lines in the island, as also on occasions of his frequent absence from Calcutta in the disturbed districts in 1857 and 1858,Babu seeb Chunder Nundi was placed in charge of the Headquarters Offce,and he subsequently constructed an alternative line from Mirzapur to Hyderabad via Jubbulpore and Nagpur.A Rai Bahadurship seems to have been a poor reward for his excellent services."


কয়েকটী মুদ্রাকর প্রমাদ

অশুদ্ধ 

 শুদ্ধ

মোস 

 মুস

ভাটা

ভাঁটা

কর্মমর্তা 

কর্মকর্তা

পুর্নোদ‍্যমে

পূর্ণোদ‍্যমে

পমিশ্রমে 

পরিশ্রমে

 পোতবার 

পোঁতবার

একাউন্টেট 

ডেপুটী একাউটেন্ট

জেনারেল বেঙ্গল 

জেনারেল্ পোষ্ট

পোষ্ট এণ্ড টেলিগ্ৰাফ্

এণ্ড টেলিগ্ৰাফ্

কেবল

কেব্ ল্(cable)

                 

    ------